আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে এভাবে মানুষ হত্যার নজির বিশ্বে নেই

>
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন ২৪ জন নিরীহ ব্যক্তি। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের পৃথক দুটি মামলা বর্তমানে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন। কবে নাগাদ এ মামলার বিচার নিষ্পত্তি হতে পারে? কী সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ? সর্বোপরি কেন এই হামলা হয়েছিল? প্রথম আলোকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন অনেক বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন প্রবীণ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান। যিনি ২০০৮ সাল থেকে প্রধান সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসাদুজ্জামান

প্রথম আলো: কবে নাগাদ মামলার বিচার শেষ হতে পারে?

সৈয়দ রেজাউর রহমান: বিচারপ্রার্থী মানুষের মনে জিজ্ঞাসা আছে, বিচার কেন শেষ হয় না? ন্যায়বিচার সমুন্নত রেখে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের চেষ্টার ফলে এখন আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যে এই বিচার নিষ্পত্তিতে পৌঁছাবে। তবে চলতি বছর রায় হবে কি না, জানি না। বিচারিক আদালতে একটি মামলা রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। রায়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে আদালতের ওপর।

গ্রেনেড হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন নেতা-কর্মীরা। ছবি: জিয়া ইসলাম
গ্রেনেড হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন নেতা-কর্মীরা। ছবি: জিয়া ইসলাম

প্রথম আলো: বিচার বিলম্বের কারণ কী?

সৈয়দ রেজাউর রহমান: আসামিপক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করার আইনি অধিকার রয়েছে। সব আসামির আইনজীবী নন, মামলার কিছু কিছু আসামির আইনজীবীরা, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের এত দীর্ঘ জেরা করেছেন, যা অপ্রাসঙ্গিক। বিচার নিষ্পত্তিতে একটু বেশি সময় লাগার কারণ হচ্ছে, দুটি মামলা একসঙ্গে বিচার চলছে। দুটি মামলা ট্রেনলাইনের মতো একসঙ্গে চলছে। এর বাইরেও বিচার বিলম্বের আরও কারণ রয়েছে। যেমন তদন্ত পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে মামলা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হোক, তা তারা তা চায়নি। একপর্যায়ে তারা প্রকৃত আসামিদের আড়াল করে জজ মিয়া নাটক সাজায়। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়। এ মামলার ঘটনায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের মজুত, সরবরাহ, বিতরণ—এটা প্রথম অভিযোগপত্রে উঠে আসেনি। তখন আদালত উভয় পক্ষের কথা শুনে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করেন। পরে অবশ্য সম্পূরক অভিযোগপত্রে তা উঠে আসে। অধিকতর তদন্তে বেশ কিছু সময় লেগেছে—প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি। এ মামলার আসামিরা অন্যান্য মামলার আসামি ছিলেন। যেমন সিলেটে হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রেখে হত্যাচেষ্টার মামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও যুদ্ধাপরাধের মামলার যেসব আসামি নিজ নিজ মামলায় শুনানির দিন গেছেন, সেদিন এই মামলার শুনানি হয়নি। এ জন্য সময়ক্ষেপণ হয়েছে। এ ছাড়া এই মামলার আসামিরা উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) গেছেন পাঁচবার। ব্যয় হয়েছে ২৯২ কার্যদিবস। এসব কারণের আলোকে বিচারপ্রার্থী মানুষ যে চিন্তাটা করেছে বা যে আশা পোষণ করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। ছবি: জিয়া ইসলাম
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। ছবি: জিয়া ইসলাম

প্রথম আলো: আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে কতটুকু সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে এসেছে?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে বাবর ছাড়াও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা আদালতে কথা বলেছেন। এখন আসামিপক্ষ আদালতে সাফাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায় শেষ হলে মামলার যুক্তিতর্কের শুনানি শুরু হবে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা মনে করছি, মামলা দুটি প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছি।

প্রথম আলো: আসামিপক্ষের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে কাউকে কাউকে আসামি করা হয়েছে। আপনার বক্তব্য কী?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: আমি বারবার উচ্চারণ করে আসছি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনার দুই মামলার একটিতেও একজন আসামিও নেই যে তাঁকে রাজনৈতিক কারণে হেনস্তা করার জন্য আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা ছিল, যা তদন্তে উঠে আসে। আদালতেও তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা বক্তব্য দিয়েছেন। উপস্থাপন করা হয়েছে সাক্ষ্য-প্রমাণও।

প্রথম আলো: কারা সেদিন হামলায় অংশ নিয়েছিল, তাদের নাম সাক্ষ্যে উঠে এসেছে কি না?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে কারা সেদিন গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, সেই নাম তদন্তে উঠে আসে। আদালতেও সাক্ষীরা সেসব আসামির নাম বলেছেন। হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আসামিরাও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। যুক্তিতর্কের শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলব।

অবিস্ফোরিত আর্জেস গ্রেনেড। ছবি: জিয়া ইসলাম
অবিস্ফোরিত আর্জেস গ্রেনেড। ছবি: জিয়া ইসলাম

প্রথম আলো: ২১ আগস্ট হামলার নেপথ্যে কী ছিল বলে মনে করেন?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: আওয়ামী লীগের সমাবেশে সেদিন কেন এই ভয়াবহ হয়েছিল, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আগস্ট মাসে বারবার হামলা করেছে। প্রথম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হামলা হয়। হামলার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে। হামলায় সরাসরি জড়িত পাঁচটি জঙ্গি সংগঠন। দেশের তিনটি আর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন দুটি। আর্জেস গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে। এই গ্রেনেড কেবল সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতে পারে, তা-ও আবার যুদ্ধক্ষেত্রে। এর বাইরে শক্তিশালী আর্জেস গ্রেনেড কেউ ব্যবহার করতে পারে না। অথচ ২১ আগস্ট সেদিন আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে হামলা করা হয়েছিল। আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে হামলা করে মানুষ হত্যা করার কোনো ঘটনা বাংলাদেশ কিংবা এই উপমহাদেশে নেই। সমগ্র পৃথিবীতে আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এভাবে মানুষ হত্যাকাণ্ডের কোনো ঘটনার নজির নেই।

হামলায় গুরুতর আহত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: জিয়া ইসলাম
হামলায় গুরুতর আহত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: জিয়া ইসলাম

মামলার সর্বশেষ অবস্থা: মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মোট সাক্ষীর সংখ্যা ৪৯১ জন। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ২২৫ জনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। গত ৩০ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। এরপর আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে মামলার ৪‍৯ জন আসামির মধ্যে ১২ জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। ৯ আগস্ট ১৩তম আসামি মাওলানা আবদুস সালামের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। ২২ আগস্টও তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
মামলার মোট আসামির সংখ্যা ছিল ৫২। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯। মামলা দুটির প্রধান আসামি মুফতি হান্নানসহ তিনজনের আরেকটি মামলায় তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে পলাতক ১৮ জন। জামিনে আটজন আর কারাগারে আছেন ২৩ জন।