প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার চিন্তা নেই: আইনমন্ত্রী

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করানোর কোনো অভিপ্রায় সরকারের নেই বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিশ্চিত করেছেন আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক। এ বিষয়ে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী বলেন, বিএনপি এ নিয়ে রাজনীতি করছে।

উল্লেখ্য, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্পর্শকাতরতা প্রকাশ পেয়েছে। আগামী মাসের গোড়াতেই জাতীয় সংসদের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন বসছে। সংসদে এ নিয়ে কতটা উত্তাপ তৈরি হবে, সে বিষয়ে অনেকের ভাবনা আছে। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিধান ৯৭ অনুচ্ছেদ নিয়ে সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।

দেশের ইতিহাসে এর আগে অনুচ্ছেদটি কখনো এভাবে আলোচনায় এসেছে বলে জানা যায় না। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোন ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।’

একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি স্মরণ করেছেন, এর আগে সেনাশাসক এরশাদের আমলে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন তাঁর দায়িত্বে থাকার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়েন। এ-সংক্রান্ত খবর যখন আসে, তখন তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে এজলাসে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সে সময়ও এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৯৭ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি।

এদিকে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার কৌশল কী হবে, তা ঠিক করতে পারছে না আওয়ামী লীগ। সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি নিতে পারে। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি তোলেননি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দরখাস্ত করা হয়।এটা সরবরাহ করতে তাদের দিক থেকে অসুবিধা নেই। হাইকোর্ট রুলস অনুযায়ী এ ধরনের দরখাস্ত অনির্দিষ্টকাল ফেলে রাখা যাবে না। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এই দরখাস্ত অচল হয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গতকালও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এক্সপাঞ্জ করার দাবিতে আন্দোলন করেছে। আওয়ামী আইনজীবী শিবিরে স্পষ্টতই একটি কট্টর ও উদারপন্থী ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা এক্সপাঞ্জ ও রায় বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের সামনে মানববন্ধন করব।’ আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুয়োমোটো এক্সপাঞ্জ হওয়ার দাবিতে আন্দোলনে আছি।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, একমাত্র রিভিউতেই এর প্রতিকার হতে পারে। আইনমন্ত্রী রিভিউর কথাই বলেছেন।’ তবে আইনবিদদের কারও কারও মতে, বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। পর্যবেক্ষণ ও রায়ের মধ্যে তফাত আছে। তাঁরা বলছেন, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ শোধরাতে হলে শুধু প্রধান বিচারপতিই সেটি পারবেন। তাঁর বেঞ্চের সতীর্থরা সেটি পারবেন না। তাঁদের মতে, এমনকি তাঁর কোনো উত্তরসূরিও এটা পারবেন না। তাঁকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষণের প্রতিকার চাইলে সেটা ‘রিভিউ’ নয়, ‘আপিল’ আকারে আসতে পারে।

সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে যে এখতিয়ার দেওয়া আছে, তা শর্তহীন কি না সেই প্রশ্ন উঠছে। বাহাত্তরের সংবিধান থেকেই এটি অবিকল টিকে আছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেলে বা তাঁর অন্য কারণজনিত অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদ প্রয়োগ হয়ে আসছে। সে রকম ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হন। গত ১১ জুন আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল যে, ৯৭ অনুচ্ছেদমতে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতকালীন (১৭ জুন-২৩ জুন) আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব প্রদান করেছেন।

দায়িত্বশীল সূত্রমতে, প্রধান বিচারপতি বিদেশ গমনের ছুটি নিজে মঞ্জুর করার পর তা সরকারকে অবহিত করেন। এরপর ওই ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অথচ এই প্রথম কেউ কেউ দাবি করছেন, এখানে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির একটি বিষয় রয়েছে। তাঁদের মতে, ‘অন্য কোনো কারণে’ রাষ্ট্রপতি যদি সন্তুষ্ট হন যে প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালনে অপারগ, তাহলে তিনি তখন আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। যদিও অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিশেষ করে সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ (প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের স্বাধীনতাবিষয়ক) আঘাতপ্রাপ্ত হয়, এভাবে সংবিধান ব্যাখ্যা করার যৌক্তিকতা নাকচ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ষোড়শ সংশোধনী মামলার একজন অ্যামিকাস কিউরি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির যদি কোনো কারণে মনে হয়, প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারক দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বা অসদাচরণে জড়িয়ে পড়েছেন, তাহলে রাষ্ট্রপতির সামনে একটিই বিকল্প, তা হলো বিষয়টি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে তদন্ত করতে অনুরোধ করা।’

৯৭ অনুচ্ছেদ-সংক্রান্ত জল্পনার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন, আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চান।’ এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এখন বাতাসে অনেক কিছু উঠছে। আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আমি এর কোনোটিতেই ফুয়েল দিতে যাচ্ছি না। নো কমেন্টস।’

প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করার বিরোধীদলীয় অভিযোগ সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘এ রকম কোনো অভিপ্রায়ই আমাদের নেই। আমরা এ রকম কোনো চিন্তাও করিনি। ওরা (বিএনপি) এ নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে।’

জানতে চাইলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে এদিকে যাওয়ার চিন্তা করাটাও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রিসভার একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য অবশ্য আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বিষয়টি অত দূর যাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘এই পর্যায়ে ও রকম কোনো দিকে যাওয়ার পরিবেশ আছে বলে মনে করি না। আন্দোলন-সংগ্রাম করে আমরা একটা চাপ রাখছি, যাতে প্রধান বিচারপতি স্বপ্রণোদিত হয়ে অনভিপ্রেত বিষয়গুলো এক্সপাঞ্জ করেন।’ শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হওয়ার মানে তাঁর খেয়ালখুশিমাফিক কোনো কারণে সন্তুষ্টি হওয়া বোঝাবে না। যেমন আমি অসুস্থ বা অসমর্থ হব, কিন্তু সেটা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কারও দ্বারা নির্দিষ্ট হতে পারে না।’