বন্যায় মাটির বাড়ি গলে কাদা

গাঢ় সবুজ শালবনের ভেতর দিয়ে পিচঢালা সরু আঁকাবাঁকা পথ। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আসা রোদ আর ছায়ার মনোরম নকশা সেই কালো পথের ওপর। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের কামদেবপুরের এই বিশাল শালবনের প্রথম বাঁক পেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ল বন্যায় বিধ্বস্ত জনপদ।

লাল মাটির উঁচু ভিতের ওপরে বিধ্বস্ত টিনের চালা তুলে নতুন করে ঘর বাঁধার কাজে ব্যস্ত ছিলেন হাবল বর্মণ আর তাঁর দুই ছেলে। স্ত্রী জ্যোৎস্না বর্মণ হাত দেড়েক লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে ভাঙা দেয়ালের বড় বড় মাটির ডেলাগুলো পিটিয়ে মেঝে সমান করছিলেন। তাঁদের দুটো ঘর ছিল, ধসে গেছে। ধর্মপুর ইউনিয়নের এই গ্রামের নাম বড় হিন্দুপাড়া। হিন্দুপাড়া নাম হলেও হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতেই বসবাস করছে। তবে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি। এখানে প্রায় দেড় শ পরিবার। বন্যা কাউকেই রেহাই দেয়নি। মাত্র ১৫-২০টি ঘর কোনো রকমে মাথা তুলে আছে। পানি এখন নেমে গেছে। গ্রামগুলোতে চলছে নতুন করে ঘর বাঁধার সংগ্রাম।

গ্রাম গলে গিয়ে লাল মাটির কাদা

লাল মাটির বৈশিষ্ট্যই হলো রোদে লোহার মতো শক্তপোক্ত আর পানি পেলে গলে যায় মাখনের মতো। ১২ আগস্ট সকাল আটটার দিকে পুনর্ভবা নদীর পানি হু হু করে বাড়তে বাড়তে ওয়াপদার বাঁধ ভেঙে শালবন, রোপা আমনের খেত, সড়ক পেরিয়ে চলে আসে বরেন্দ্র এলাকার এই গ্রামগুলোতে। টানা তিন দিন পানি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এরপর যেমন দ্রুত পানি এসেছিল, তেমনি আবার দ্রুত নেমেও যায়। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।

গত সোমবার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ধর্মপুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেল, গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি পানিতে ধসে গিয়ে লাল মাটির কাদায় পরিণত হয়েছে। এই গ্রামগুলো একেবারে দেশের প্রান্তবর্তী। ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন। কামদেবপুর, বনগাঁ, চৌপুকুরিয়া, মির্জাপুর, মহলবাড়ি, শালবাড়ি, কমলপুর, জামকুঁড়ি, বড় ও ছোট হিন্দুপাড়া, গাডামপাড়া, রানীপুর, ধর্মজান; এসব গ্রামের কোনো কোনোটির কিনার ঘেঁষে চলে গেছে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া।

বিরল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম রওশন কবির জানালেন, প্রাথমিক হিসাবে এই উপজেলায় ২ হাজার ৪০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর সিংহভাগই ধর্মপুর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা হলো তাঁর ইউপি কার্যালয়ে। তিনি জানালেন, প্রায় ৪ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ করছে।

বন্যায় একমাত্র গ্রামীণ সড়কটির বিভিন্ন জায়গা ভেঙে গেছে। একটি সেতুর দুপাশের মাটি আলগা হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর জরুরি মেরামতের ফলে কোনো রকমে যান চলাচলের ব্যবস্থা হয়েছে।

কাদাপানিতে পায়ে ঘা

কামদেবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সেলিম বললেন, বহু বছর ধরে এই এলাকার মানুষ মাটির বাড়িতে বংশপরম্পরায় বসবাস করে অভ্যস্ত। বান-বন্যার সঙ্গে তাদের তেমন পরিচয় নেই। পুনর্ভবা বলতে গেলে একরকম মরা নদী। সেই নদীতে এমন বান আসবে, তা তাদের কাছে অকল্পনীয়। পানিতে ডুবে ঘরের মাটির দেয়ালের গোড়া নরম হয়ে যায়। তারপর একসময় পুরো ঘরটি দেবে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনো অভিজ্ঞতাই তাদের ছিল না। ফলে ক্ষতিও হয়েছে প্রচুর। পানি নেমে গেলেও এখন পিচ্ছিল কাদায় ভরা গ্রামগুলোর পথে চলাই মুশকিল। জামকুঁড়ির গোলাম মোস্তফা বললেন, কাদাপানির ভেতর দিয়ে চলাফেরা করতে করতে তাঁদের পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঘা হয়ে যাচ্ছে।

বিধ্বস্ত সাঁওতাল গ্রাম

শালবনের ভেতরের সড়কের ওপর দিয়ে সারি সারি পলিথিনের ঝুপড়ি ফেলে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে দুর্গত মানুষ। বালিশ-কাঁথা থেকে শুরু করে ভিজে যাওয়া সংসারের হরেক রকম জিনিসপত্র শুকাতে পথের ওপরেই বিছিয়ে দিয়েছে। তাতে অসুবিধা নেই। কারণ, এখনো এই পথে যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে।

ভিজে যাওয়া চাল সড়কের ওপরে পলিথিন পেতে মেলে দিচ্ছিলেন রানীপুর সাঁওতাল পাড়ার সাবিনা সরেন। পাশেই বনের ভেতর থেকে কাঠ কুড়িয়ে এনে রাখছিলেন তারা মুর্মু আর সানজিলি সরেন। তাঁরা জানালেন, রানীপুর সাঁওতাল গ্রাম পুরোটাই বিধ্বস্ত। শালবন থেকে মন উদাস করা ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছিল। তা হয়তো সাবিনার কানেই পড়ছিল না। তাঁদের ঘর গেছে, বর্গা নিয়ে খানিকটা জমিতে রোপা ধান চাষ করেছিলেন। তা-ও নষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি যা বললেন তা এ রকম, ‘আমার দুঃখকষ্ট কি আর আপনি বুঝবেন! আবাদ গেল, বাড়িও গেল, আমার যে কী কষ্ট কেবল আমিই বুঝি।’

ভেসে গেছে সীমান্তখুঁটি

পুনর্ভবা নদীর পাশ দিয়ে ওয়াপদার বাঁধ এসে শেষ হয়েছে ছিট সুন্দরা গ্রামে। এখানেই বাংলাদেশের সীমান্ত শেষ। তারপর ভারতের মল্লিকপুর গ্রাম। ঠিক এই জায়গাতেই ভেঙে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এই বাঁধভাঙা পানিই ঢুকেছে ধর্মপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। ভাঙা অংশে নদীর ভেতর ভারতীয় বিএসএফের পক্ষ থেকে দুই দিন আগে একটি বাঁশের খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়েছে। খুঁটির মাথায় পোঁটলার মতো করে কাপড় জড়ানো। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এই বাঁশের খুঁটি আগের সীমান্তখুঁটির (পিলার) চেয়ে অনেকটা এগিয়ে (বাংলাদেশের ভেতরে) পুঁতে দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল গ্রামের কয়েকজন দুরন্ত শিশু-কিশোর কলাগাছের ভেলায় করে অনায়াসে স্রোতে ভেসে ভেসে বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় ভারত-বাংলাদেশে যাতায়াত করছে।

এ বিষয়ে জানতে সোমবার দুপুরে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নায়েব সুবাদার মোসলেম উদ্দিন জানালেন, ছিট সুন্দরা সীমান্তের ৩১৯ নম্বর মূল পিলারের ৪ নম্বর সাব-পিলারটি ভেসে গেছে। বিজিবি-বিএসএফ কর্মকর্তাদের সীমান্ত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। এখন এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

নৌকা রাখা হবে

দিনাজপুর জেলা সদর থেকে অনেক দূরে বিরলের এই গ্রামগুলোতে ত্রাণ পৌঁছাতেও বিলম্ব ঘটেছে বলে অভিযোগ করলেন গ্রামবাসীরা। এ সম্পর্কে স্থানীয় সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বললেন, আকস্মিকভাবে এসব গ্রামে পানি প্রবেশ করে রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় প্রথম তিন দিন সেখানে পৌঁছানোর কোনো উপায়ই ছিল না। আবার অনেকে ত্রাণশিবিরে আসতে চাননি। সারা উপজেলায় নৌকা ছিল মাত্র তিনটি। ফলে সেনাবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তাদের স্পিডবোটে করে প্রথমে জরুরি খাবার, পানি এসব দেওয়া হয়েছে। এখন স্বাভাবিক ত্রাণ তৎপরতা চলছে। এই অঞ্চলে এ ধরনের বন্যার অভিজ্ঞতা ছিল না। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত একটি করে নৌকা তৈরি করে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ব্যবস্থা করবে।