দুই উপজেলায় ১১ হাজার হেক্টরে হচ্ছে না ধান চাষ

গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছিলেন কৃষক অমল রায়। অতিবর্ষণের ফলে ভবদহে জলাবদ্ধতায় তাঁর সব ধানখেত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একই কারণে এবার তিনি সেই জমিতে আমনের চারা রোপণই করতে পারেননি।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাঁচকাটিয়া গ্রামের এই কৃষক বললেন, ‘এবার জমিতে চারা রোপণের আগে থেকেই জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। খেতে এখনো কোমরসমান জল। এ কারণে এবার আমন ধান লাগাতে পারিনি। খুব বিপদে আছি।’

জলাবদ্ধতার কারণে অমল রায়ের মতো অভয়নগর ও মনিরামপুরের ভবদহ অংশের বহু কৃষক এবার আমন ধানের আবাদ করতে পারেননি। উপজেলা দুটির প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে এবার এ ধানের চাষ হবে না।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ ভবদহ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদে পলি পড়ায় নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় গত বছরের ৯ ও ১০ আগস্টের টানা বর্ষণে ভবদহ অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ তলিয়ে গিয়েছিল। এতে মাঠের পর মাঠ কৃষকের ধানখেত নষ্ট হয়। এবার তারও আগে টানা বর্ষণ শুরু হওয়ায় কৃষকেরা চারা রোপণই করতে পারেননি। চলতি বছর কয়েক দফা ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে ভবদহ অঞ্চল। গত কয়েক দিন ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলোতে এখনো পানিতে ভরপুর।

ভবদহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিল বোকড় ও বিল কেদারিয়া। গতকাল সোমবার এ দুটি বিলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শুধুই অথই পানি। বিলের পাশ দিয়ে যেসব রাস্তাঘাট আছে, সেগুলোরও অনেক স্থান তলিয়ে আছে। বিলের কোথাও কোনো ধানখেত চোখে পড়েনি। আছে কেবল শাপলা আর আগাছা।

স্থানীয় অন্তত ১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলি জমায় নদীর বুক বিল থেকে কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে। ফলে নদী দিয়ে এখন আর পানি সরছে না। বিলের পানি বিলেই থেকে যাচ্ছে। বিলের বেশির ভাগ এলাকায় এখনো হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। নিচের দিকে এক মানুষ সমান পানি আছে। চলতি মৌসুমে আমনের চারা রোপণের সময় প্রায় শেষ। এখনো বিলের পানি না নামায় কৃষকেরা আমন ধান চাষের আর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না।

অভয়নগর উপজেলার সড়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক তপন সরকার বলেন, ‘বিল এলাকায় আমার তিন বিঘা জমি আছে। গত বছর অন্তত আমন ধানের চারা রোপণ করতে পেরেছিলাম। যদিও পরে জলাবদ্ধতার কারণে সব ধানের চারা মরে যায়। কিন্তু এবার জলাবদ্ধতার কারণে বীজতলাই তৈরি করতে পারিনি। তা ছাড়া জমিতে এখনো তিন-চার হাত জল রয়েছে। এবার আর আমন ধান লাগানো সম্ভব হবে না।’

দুই বছর আগেও ভবদহের অভয়নগর অংশে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে এবং মনিরামপুর অংশে প্রায় নয় হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে এবার এসব জমির কোথাও কোনো আমন ধানের চাষ হয়নি।গত বছর কৃষকেরা আমনের চারা রোপণ করলেওজলাবদ্ধতার কারণে ৮ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমির ধানখেত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

মনিরামপুর কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, গত মৌসুমে মনিরামপুরে আমন আবাদ হয়েছিল মোট ২২ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে। ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার কারণে ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছিল। উপজেলার কুলটিয়া, নেহালপুর, মনোহরপুর, দূর্বাডাঙ্গা, হরিদাসকাটি, ঢাকুরিয়া ও শ্যামকুড় ইউনিয়ন—এই সাতটি ইউনিয়ন এ অঞ্চলে পড়েছে।

মনিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, জলাবদ্ধ থাকায় উপজেলার ওই সাতটি ইউনিয়নে এবার আমন ধানের আবাদ হচ্ছে না। তবে এবার উপজেলার বাকি ১১টি ইউনিয়নে আমনের আবাদ
বেড়েছে। ফলে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে। উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় ২১ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমি। এ পর্যন্ত চাষ হয়েছে ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি।

তবে অভয়নগর কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এ উপজেলায় এবার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। উপজেলায় এবারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। এ পর্যন্ত চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৭৪০ হেক্টর। গত বছর অভয়নগরে মোট আমনের আবাদ হয়েছিল ৭ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। ভবদহে জলাবদ্ধতার কারণে নষ্ট হয়েছিল ৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমির ধান। অভয়নগরের প্রেমবাগ, সুন্দলী, চলিশিয়া ও পায়রা—এই চারটি ইউনিয়ন ভবদহ অঞ্চলে পড়েছে।

অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ছামদানী বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে উপজেলার ভবদহ এলাকায় এখনো এক হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা যায়নি। আমরা কিছু ভাসমান বীজতলা তৈরি করে রেখেছি। কৃষকদের মাঝে প্রচারপত্র বিতরণ করে তাঁদের সচেতন করা হচ্ছে। শেষ সময়ে এসে যদি কিছুটা পানি নেমে যায় তাহলে ওই বীজতলা থেকে চারা নিয়ে জমিতে রোপণ করা যাবে।’

আমন ধানের চারা রোপণের শেষ সময় ধরা হয় ২০ আগস্ট। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নাবি আমন ধানের চারা রোপণ করা যাবে।