গভীর সাগরে মিঠা পানি?

ভরা মৌসুমেও উপকূলের নদ-নদীতে তেমন ইলিশ মিলছে না। গভীর সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও তা আকারে ছোট। গভীর সাগরে মাছ ধরা জেলেদের দাবি, বঙ্গোপসাগরের গভীরে তাঁরা মিঠা পানি পেয়েছেন। তাঁদের ধারণা এ কারণেই হয়তো এবার ইলিশ উপকূলের নদ-নদীতে আসছে না।

তবে ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকো ফিশ প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, গভীর সাগরে মিঠা পানির সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি অসম্ভব। আর এটা ইলিশের জীবনচক্রের ওপর প্রভাবের কারণেও হচ্ছে না। মূলত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ সাগর থেকে উপকূলের নদ-নদীতে আসার পথে গভীর সাগরে আটকা পড়ছে। আমরা আশা করছি, ভাদ্রের প্রথম চন্দ্র থেকে পরবর্তীতে পূর্ণ চর্দ্রে উপকূলের নদ-নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। সাগরে ইলিশ বেড়েছে এটা ঠিক। কারণ, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জাটকা সংরক্ষণে সফলতার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।

প্রায় ৪০ বছর ধরে গভীর সাগরে মাছ ধরেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাবুল মাঝি ও হামিদ মাঝি। হামিদ মাঝি বলেন, ৩৫ বছরে বঙ্গোপসাগরে মিঠা পানির পাননি। কিন্তু এবার উপকূল থেকে ১০০-১৫০ কিলোমিটার গভীর মিঠা পানির পেয়েছেন। আর সেখানে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। মুখে নিয়ে ওই পানি পরখ করে দেখেছন তাতে লবণের কোনো অস্তিত্ব নেই।

বাবুল মাঝি বলেন, এবার সাগরে চার ধরনের জল দেখা যাচ্ছে। লাল, নীল, ঘোলা ও কালচে রঙের। লাল রঙের পানি খুব মিষ্টি, নীল রঙের পানি কিছুটা মিষ্টি তবে ঘোলা ও কাল রঙের পানি আগের মতোই খুব লোনা। মূলত লাল ও নীল রঙের পানির বিচরণ যেখানে সেখানে জাল ফেললেই প্রচুর ইলিশ মিলছে।

জেলেদের ধারণা, এবার অধিক বৃষ্টিপাত ও ঢলের পানি সাগরে ধাবিত হওয়ায় গভীর সাগরে পানির এমন বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরীও এমন তথ্য জানান।

পাথরঘাটা উপজেলার কয়েকজন ক্ষুদ্র জেলের ভাষ্যমতে, বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ইলিশ ধরা পড়ার সম্পর্ক আছে। যে বছর বৃষ্টিপাত বেশি হয় সে বছর নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। এবার প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও নদ-নদীতে ইলিশ মিলছে না।

দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রগামী ট্রলারের জ্যেষ্ঠ মাঝি ছগির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশ মাছ পূবাল (পূর্ব) বাতাসে ঘর গাঙ্গে (উপকূলীয় নদ-নদীতে) আসে। কিন্তু দিন দিন পূবাল বাতাসের সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি কমে যাচ্ছে। তাই নদ-নদীতে ইলিশ খুবই কম পড়ছে। বর্তমানে পশ্চিমা বাতাসের কারণে গভীর সাগরে গিয়ে লাল পানি বা নীল রঙের পানি খুঁজে ইলিশ শিকার করছেন। ওই পানি খুবই মিষ্টি। তবে কালো ও ঘোলা পানিতে ইলিশের দেখা নেই। ছগির মাঝি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘৪০ বছর সাগরে মাছ ধরি। কিন্তু এর আগে কোনো দিন বঙ্গোপসাগরে মিষ্টি পানি পাইনি।’

শুধু জেলে নয় এ অঞ্চলের ইলিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে। প্রতি বছর মৌসুমে কয়েক শ কোটি টাকা লগ্নি হয় দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ অর্থনীতিতে। পাথরঘাটা মৎস্য আড়তদার সমিতির সদস্য বাবুরাম কর্মকার বললেন, স্থানীয় নদ-নদীর ইলিশের গুণমান ভালো থাকায় এর চাহিদা ও মূল্য বেশি। তবে চাহিদানুযায়ী সামান্য ইলিশও মিলছে না।

পাথরঘাটায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, ১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ৭ লাখ ১৪ হাজার ২০০ কেজি ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। বিএফডিসির বিপণন কর্মকর্তা আহম্মেদ উল্লাহ বলেন, ইলিশ মাছ উপকূলীয় নদ-নদীর মিষ্টি পানিতে না আসায় আকারে বড় হচ্ছে না।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রান্তিক জেলেদের আর্থিক ক্ষতির চেয়েও তাদের কাছে বড় হতাশার কথা হল, এই সময় কোনোক্রমেই ইলিশ সাগরে লবণ জলে বসে থাকার কথা নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইলিশের জীবনচক্র এমনই। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হওয়ায় ভাবিয়ে তুলেছে তাঁদের। পাশাপাশি মিঠা পানির সন্ধান পাওয়ায় সামুদ্রিক প্রতিবেশে বড় কোনো পরিবর্তন বলেও মনে করছেন তাঁরা।

বরিশাল নগরের পাইকারি বাজার পোর্ট রোড মৎস্য বন্দরের আড়তদার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী বলেন, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু আশানুরূপ ইলিশ নেই। নদ-নদীতে মাছের আমদানি খুবই কম। কিন্তু গভীর সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে। গত রোববার এই বন্দরে ৩০০ মণ ইলিশ এসেছে।