চিড়িয়াখানায় ভিড় বেশি, প্রাণীরা ধকলও সইছে বেশি

শাহবাগের শহীদ জিয়া শিশুপার্কে শিশুদের অন্যতম আকর্ষণ টয় ট্রেন। সেই ট্রেনে চড়েছে শিশুরা। গতকাল তোলা ছবি
শাহবাগের শহীদ জিয়া শিশুপার্কে শিশুদের অন্যতম আকর্ষণ টয় ট্রেন। সেই ট্রেনে চড়েছে শিশুরা। গতকাল তোলা ছবি

ঈদের ছুটিতে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থী ছিল অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। মানুষের ভিড় সামলাতে লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি চিড়িয়াখানাজুড়ে ছিল বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা।

এই চিড়িয়াখানায় আছে ২ হাজার ৬৮১টি প্রাণী। গত তিন দিনে বিপুল দর্শনার্থীর আকর্ষণও ছিল তারা। ফলে প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হয়েছে লাখো মানুষের সরব উপস্থিতিতে। সচেতনতার অভাবে এসব প্রাণীর প্রতি অনেকের আচরণ উৎপীড়নের পর্যায়ে পড়ে যায়।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাবমতে, ঈদের প্রথম তিন দিনে প্রায় তিন লাখ মানুষ চিড়িয়াখানায় এসেছে। গতকাল তৃতীয় দিনে ভিড় ছিল সবচেয়ে বেশি। গতকাল সোমবার কমবেশি দেড় লাখ দর্শনার্থী ঢুকেছে ১৮৭ একরের এই চিড়িয়াখানায়। অন্য সময়ে দিনে গড়ে ১৫ হাজার মানুষ আসে। তবে ছুটির দিনে সংখ্যা কিছুটা বাড়ে।

উটপাখি দেখছে দর্শনার্থীরা। ছবিটি গতকাল মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে তোলা
উটপাখি দেখছে দর্শনার্থীরা। ছবিটি গতকাল মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে তোলা

১৩৯ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্র থাকে বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ময়ূর, জলহস্তী, উটপাখি আর বানর। বানরের খাঁচার সামনেই মানুষের অস্বাভাবিক আচরণটা বেশি দেখা যায়। বানরকে বাদাম, কলা, চিপস, কাঁঠাল পাতা ও আম পাতা খাওয়াতে গিয়ে হাতের কাছে পাওয়া প্লাস্টিকের বোতলসহ এটা-সেটা দিয়ে ঢিল মারার প্রবণতা দেখা গেছে। সাপ দেখেও অনেক শিশু খুশি।

রাজীব, খোরশেদ, হৃদয়রা নয় বন্ধু চিড়িয়াখানায় এসেছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত থেকেও পুরোটা ঘুরে দেখতে পারেনি। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই ছেলেরা একই রকম পাঞ্জাবি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল জেব্রার বেষ্টনীর সামনে।

শুধু তারা নয়, অনেকেই পরিবার নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে এসেছে। তবে দর্শনার্থীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ অভিভাবককেই শিশুদের প্রাণী চেনাতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে জিরাফের বেষ্টনীর সামনে। ছোট-বড় মিলিয়ে সাতটি জিরাফ শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মনেই আনন্দ খোরাক জুগিয়েছে সমান তালে। বাবাদের কাঁধে ছিল সন্তানেরা। অনেকে ব্যস্ত ছিলেন সেলফি তুলতে।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদে সাত স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে চিড়িয়াখানায়। টহল পুলিশ, আনসারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া র‍্যাব ও ভ্রাম্যমাণ পুলিশও ছিল।

খেলনায় ফুঁ দিয়ে বুদ্‌বুদ তৈরির খেলায় মেতেছে শিশুটি। শহীদ জিয়া শিশু পার্কের সামনে থেকে ঈদের দিন বিকেলে তোলা ছবি
খেলনায় ফুঁ দিয়ে বুদ্‌বুদ তৈরির খেলায় মেতেছে শিশুটি। শহীদ জিয়া শিশু পার্কের সামনে থেকে ঈদের দিন বিকেলে তোলা ছবি

বিপুলসংখ্যক মানুষ আবদ্ধ এসব প্রাণী দেখে, তাদের সঙ্গে নানা রকম মিথস্ক্রিয়া করে আনন্দ পেলেও প্রাণীদের জন্য তা সব সময় সুখকর ছিল না। অনেক প্রাণী দিনের বেলায় নির্দিষ্ট সময় ঘুমায়। বেশি মানুষের উপস্থিতিতে যেমন তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে; আবার অনেককে দেখা গেছে, ঢিল ছুড়েছে বা নানা হাঁকডাক করে ঘুমন্ত প্রাণীকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো প্রাণীকে খাবার দিয়েছেন কেউ কেউ। সেলফি তুলতে গিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনীও পার হয়েছেন কেউ কেউ। ঝুঁকির বিষয়টিও তাঁরা উপেক্ষা করছেন।

চিড়িয়াখানার প্রাণী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, এত দর্শনার্থীর ধকলের পর প্রাণীরা অস্বাভাবিক আচরণ করে। ঠিকমতো খাবার খায় না। চিৎকার বা গর্জন করে বেশি পরিমাণে শক্তি ক্ষয় করে বলে তারা অসময়ে দুর্বল হয় পড়ে। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

বাঘের প্রতি দর্শনার্থীদের আগ্রহ সব সময়ই বেশি। গতকাল বেলা দুইটার দিকে বাঘের খাঁচার সামনে একদল মানুষকে দেখা যায় ঘুমন্ত বাঘকে জাগানোর নানা কসরত করতে। না পেরে বিরক্তও হন কেউ কেউ।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে বাঘকে খাবার দেওয়া হয়। খাবার শেষ করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। এরপর বাঘ ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ দুপুর ১২টা থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে। সঙ্গে বাড়ে তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ।

জিরাফ দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়। এই ছবি জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে গতকাল তোলা
জিরাফ দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়। এই ছবি জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে গতকাল তোলা

তবে উৎসবকে ঘিরে প্রাণীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু আগাম প্রস্তুতি নেয় বলে জানায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। প্রাণী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, কিছু প্রাণীকে অ্যান্টি-স্ট্রেস ওষুধ হিসেবে স্যালাইন, ইলেকট্রোলাইট ও মাল্টিভিটামিন দেওয়া হয়েছে। তবে এই ঈদে এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণী অসুস্থ হয়নি।

উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রাণীদের শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলাতে আগে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও এবার হয়নি। এর কারণ হিসেবে কিউরেটর নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে বন্যা পরিস্থিতির কারণে ভিড় কম হবে ভেবে এবং বসার জায়গার ব্যবস্থা করতে না পারায় বোর্ড গঠন করা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে করা হবে।

ছবিগুলো তুলেছেন
হাসান রাজা ও
সাইফুল ইসলাম