অধিগ্রহণে ৭ বছর দেরি করায় জমির দাম দ্বিগুণ!

জমি অধিগ্রহণ না করে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করায় এখন দ্বিগুণেরও বেশি দামে সেই জমি কিনতে হচ্ছে। আবার লেকপাড়ে হাঁটাপথ নির্মাণ এবং লেকের পাড় বাঁধাই করা হলেও দুর্বল কাঠামোগুলো ভেঙে যাচ্ছে।

রাজধানীর অভিজাত এলাকার এই লেকগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করা, প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে সৌন্দর্য বাড়ানো, চিত্তবিনোদনের সুযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশন (রাজউক) লেক উন্নয়নের এই প্রকল্প শুরু করেছিল।

প্রকল্পের মোট জায়গা ৩০০ একর। এর মধ্যে লেকে রাজউকের নিজস্ব জায়গা ২১৬ একর। বাকি ৮৪ একর লেকের ধারের ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা। ২০১০ সালে যখন প্রকল্প শুরু হয়, তখন এলাকায় ওই ৮৪ একর ভূমির গড় দাম ছিল প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। তখন অধিগ্রহণ না করায় এখন খরচ পড়বে ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে রাজউককে এই প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পের শুরুতে জমি অধিগ্রহণের খরচ ধরা হয়েছিল ৩১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পের উন্নয়ন খরচ শুরুতে ধরা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। এখন বিভিন্ন স্থাপনা ও উপকরণ বাড়িয়ে উন্নয়ন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে আরও ৯০০ কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের প্রস্তাবে জমির দাম ও উন্নয়ন খরচ কম দেখানো হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদনের জন্য।

প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রকল্পেই এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। প্রকল্প ব্যয় কম দেখিয়ে যেকোনোভাবে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে ব্যয় বাড়তে থাকে। যেহেতু কাজ কিছু হয়ে যায়, তখন সরকার বাধ্য হয় বরাদ্দ বাড়াতে।

যোগাযোগ করা হলে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, প্রকল্পের দাম কম দেখানো কিংবা জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই ওই সময়ে কাজ শুরু করার বিষয়টি আসলেই ঠিক ছিল না। এখন এই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে।

 সাত বছরে দামের তারতম্য

ঢাকার কেন্দ্রীয় ভূমি নিবন্ধনকার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে প্রকল্পভুক্ত বনানী লেকপাড়ে প্রতি কাঠার সরকারি মূল্য ছিল ১০ লাখ টাকা। এখন সেই দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। মহাখালী মৌজায় প্রতি অজুতাংশ (শতাংশের ১০০ ভাগের এক ভাগ) ভিটা জমির দাম ছিল ১৯ হাজার ৫৩৮ টাকা। এখন দাম ৩৬ হাজার ২৫৫ টাকা। প্রকল্পের ৬৮ একর জায়গা নিতে হচ্ছে এই মৌজা থেকে

এ ছাড়া প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পড়েছে কড়াইল, তেজগাঁও, ভাটারা মৌজায়। এসব মৌজায় জমির দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। দীর্ঘদিন জমির নিবন্ধন বন্ধ রাখায় বাড্ডা এলাকায় জমির দাম কম বেড়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নজরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১০-১১ সালে ভূমির দাম কম ছিল। সেই তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আমরা সম্ভাব্য বাস্তব দাম ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি। তবে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু হবে।’

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেরই জায়গা রয়েছে শাহজাদপুরের মানারাত স্কুলের পেছনে এবং গুলশান শুটিং ক্লাবের পেছনে বাড্ডা এলাকায়। যাঁদের জায়গার ওপর দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে, তাঁদের ১৭ জন ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেছেন।

সাত বছরে উন্নয়ন সামান্য

প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। এখন নতুন মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সাত বছর সময় চলে গেলেও তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা নির্মাণ, কিছু অংশে পাড় বাঁধাই এবং কিছু খননকাজ ছাড়া প্রকল্পের তেমন উন্নয়ন হয়নি। তবে যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলো টেকসই হয়নি।

গুলশান শুটিং কমপ্লেক্সের পেছন থেকে (বাড্ডা) শুরু হয়ে গুলশান-২-এর শাহজাদপুর মরিয়ম টাওয়ার পর্যন্ত লেকপাড়ে রাস্তা হয়েছে। গত শুক্রবার শুটিং কমপ্লেক্সের পেছনে গিয়ে দেখা যায়, লেকপাড়ের রাস্তাটি এরই মধ্যে এখানে-সেখানে ভেঙে গেছে। রাস্তা নির্মাণে খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। রাস্তার জায়গা দখল করে ছয়টি ছোট দোকানঘর বসেছে। এ ছাড়া দুপুরের পর রাস্তা ও লেকপাড়ে বাজার বসে। গুলশান ৩২ নম্বর সড়কের শেষে লেকপাড়ে রয়েছে চায়ের দোকান ও ভাতের হোটেল। জানতে চাইলে চা-দোকানি রশিদ মিয়া বলেন, আপাতত এখানে বসেছেন, পরে ছেড়ে দেবেন।

খননকাজের জন্য ৩৯ কোটি টাকা বাজেটের ১৬ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। ৫০ শতাংশ কাজ বাকি থাকতেই খনন করা জায়গা আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বনানী কবরস্থানের কাছে, চেয়ারম্যান বাড়ির পেছনে, বনানী ১১ নম্বর সেতুর কাছে এমন অবস্থা দেখা যায়। গুলশান ৩২ নম্বর সড়কের কাছে এবং নিকেতন মোড়েও কিছু খননের কাজ চলে। কিন্তু মামলাজনিত সমস্যার জন্য সেখানে কাজ বন্ধ হয়ে আছে। নতুন করে হাতিরঝিল থেকে বাড্ডা হয়ে শাহজাদপুর পর্যন্ত ‘ড্রাইভওয়ে’ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তবে বৃষ্টির জন্য কাজ আবার থেমে যায়। গুলশান ৩২ নম্বর সড়কের কাছে লেকপাড়ে হচ্ছে পায়ে চলার পথ বা ওয়াকওয়ে।

দেখা যায়, মহাখালী থেকে গুলশানে আসার পথে কাদেরীয়া টাওয়ারসহ লেকের কিছু স্থানে বাঁধাই করা পাড় ভেঙে গেছে। গত বছর গুলশান ১ এলাকার ৫৫ নম্বর সড়ক এবং বনানী ১৮ নম্বর সড়কে রাস্তাও ধসে পড়ে। এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সার্বিকভাবে মাটি পরীক্ষা না করে ঢালাওভাবে কাজ করা হয়েছিল। সঠিকভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয় নি।

রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, কেউ অনিয়ম করে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, লেকের পানি শোধনের জন্য নতুন করে চারটি শোধনাগারও রাখা হচ্ছে। লেকের ওপর নতুন করে আটটা সেতু করা হবে।