তদন্ত চলছে ঢিমেতালে

তুফান সরকার
তুফান সরকার

বগুড়ার সেই আলোচিত ছাত্রী ধর্ষণ মামলার তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার অভিযোগপত্র এক মাসের মধ্যে দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে পুলিশ। আর জেলা প্রশাসনের করা কমিটি ৪০ দিনেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিদের আপস-মীমাংসার সুযোগ করে দিতেই অভিযোগপত্র দিতে দেরি করছে পুলিশ।

গত ১৭ জুলাই কলেজে ভর্তির কথা বলে বগুড়ার এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেন শহর শ্রমিক লীগের তৎকালীন আহ্বায়ক (পরে বহিষ্কৃত) তুফান সরকার। পরে তুফানের সহযোগীরা ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তাঁর মাকে মারধর করে এবং মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এ ঘটনায় ২৮ জুলাই রাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে দুটি মামলা হয়। মামলার এজাহারভুক্ত ৯ জনসহ ১১ আসামিকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। আগস্ট মাসের মধ্যেই আদালতে মামলা দুটির অভিযোগপত্র দাখিলের কথা জানিয়েছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দিনক্ষণ বেঁধে দিয়ে এ মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকার, তাঁর স্ত্রী আশা সরকার, আশার বড় বোন নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া আকতারসহ মোট ১১ জনকে দুটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে তুফান সরকারের সহযোগী মুন্না, আতিকুর রহমান ও নাপিত জীবন রবিদাস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে ৭ আগস্ট নির্যাতিত মেয়েটিকে রাজশাহী মহানগরীতে নিরাপদ হেফাজতে এবং তাঁর মাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়। কারাগারে মাদক সেবনের অভিযোগ ওঠায় প্রধান আসামি তুফান সরকারকে বগুড়া থেকে কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বগুড়া শিশু আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, সবাই পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তদন্ত শেষ করার ব্যাপারে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রী ধর্ষণ মামলার শুরু থেকেই পুলিশকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। এসবে পাত্তা না দিয়ে পুলিশ নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। তদন্ত পর্যায়ে আপস-মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই।

 জেলা প্রশাসনের তদন্তেও ধীরগতি

এদিকে এ ঘটনা তদন্তে বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয় ৩০ জুলাই। কিন্তু ৪০ দিন পেরোলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি কমিটি।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সামাদ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সাক্ষ্য প্রদানের জন্য তদন্ত কমিটি পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। এতে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। এ পর্যন্ত চার-পাঁচজন সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। ঠিকমতো সাক্ষ্য না পাওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্বিত হচ্ছে।

এ কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম এবং জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহিদুল আলম। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে কমিটিকে দিনক্ষণ বেঁধে দেওয়া হয়নি। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটির কাছে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়া সভাপতি মাসুদার রহমান হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতনের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারত। কিন্তু তা না করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাক্ষীদের স্বপ্রণোদিত হয়ে আসতে বলা হয়েছে। আসামিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউই তা করবে না। যেভাবে তদন্ত হচ্ছে তাতে তদন্তের নামে এটাকে প্রহসন বলেই মনে হচ্ছে।