বালু ব্যবসার দাপটে চা-বাগান সংকটে

ছোট ছোট পাহাড়ের কোলজুড়ে ছিল মনোরম চায়ের বাগান। কিছুদূর পর পর ছিল ছায়াতরু। বৃষ্টির পানি সেগুলোকে ছুঁয়ে পড়ত পাশের ছোট ছোট ছড়ায়। সেই চিত্র পাল্টে গেছে।
বালু ব্যবসায়ীরা ছড়াগুলোর বালু নির্বিচারে কেটে প্রশস্ত খালের মতো বানিয়ে ফেলেছেন। সেই খালে ধসে পড়ছে চা-গাছ। ভেঙে পড়েছে একটি কালভার্ট।
পরিবেশ বিপর্যয়ের এ ঘটনাটি ঘটছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চণ্ডীছড়া চা-বাগানে। বাগানের ভেতরে বালুমহালের ইজারা দেওয়া নিষেধ থাকলেও চা-বাগান কর্তৃপক্ষ তা লঙ্ঘন করেই ব্যবসায়ীদের ইজারা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা নির্বিচারে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু তোলায় পুরো বাগানের চিত্রই পাল্টে গেছে। কমে গেছে সবুজের ছোঁয়া।
পরিবেশ রক্ষায় দ্রুত বাগানের বালু ব্যবসা বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন জানায়, জেলায় ২৩টি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে ওই চা-বাগান এলাকায় পড়েছে পাঁচটি। বাপার হবিগঞ্জ শাখা চা-বাগানের ভেতরে অবস্থিত বালুমহালগুলোর ইজারা না দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলা প্রশাসন দুই বছর ধরে বাগানের ভেতরে বালুমহালগুলো ইজারা দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
ওই নির্দেশের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন চণ্ডীছড়া চা-বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের বাগানের ভেতরে প্রবাহিত ছড়াগুলো পরিষ্কার ও সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন চায়। জেলা প্রশাসন তাদের অনুমোদনও দেয়। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ আইন লঙ্ঘন করে বাগানের ছড়াগুলোকে বালুমহাল হিসেবে ব্যবসায়ীদের ইজারা দেয়।
গত বুধবার চণ্ডীছড়া বাগানে গিয়ে দেখা যায়, অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। শ্রমিকেরা বাগানের বিভিন্ন ছড়া থেকে শ্যালো মেশিন ও বেলচার সাহায্যে বালু তুলে ঢাকা-সিলেট পুরোনো মহাড়কের ওপর জমা করছেন।
শ্রমিকেরা জানান, চুনারুঘাট রাজার বাজার এলাকার বকুল পালের হয়ে তাঁরা বালু তুলছেন। বকুল পালের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে রয়েছেন চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ও একই এলাকার ব্যবসায়ী সজল দাস।
যোগাযোগ করা হলে বকুল পাল বলেন, জেলা প্রশাসন বাগানের ভেতরের বালুমহালগুলো সংশ্লিষ্ট বাগান কর্তৃপক্ষকেই ইজারা দেয়। এ কারণে তিনি ও তাঁর অংশীদারেরা বাগান কর্তৃপক্ষকে ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছেন। বাগান কর্তৃপক্ষ ওই টাকা থেকে জেলা প্রশাসনকে রাজস্ব বাবদ ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেয় বলে তিনি দাবি করেন।
বাগান এলাকার বাসিন্দা আবদুল হান্নান বলেন, এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বাগান কর্তৃপক্ষ ছড়া পরিষ্কারের নামে বালু ব্যবসা করছে। এতে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
বাপার হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, চণ্ডীছড়া চা-বাগানের সবুজ নেই বললেই চলে। বালু ব্যবসায়ীরা ছড়ার ভেতরে মেশিন ও ট্রাক্টর ঢুকিয়ে যেনতেনভাবে বালু তুলছেন। এতে একেকটি ছড়ার আয়তন বেড়ে চার-পাঁচ গুণ হয়ে গেছে। পাহাড় ভাঙছে, গাছগাছালিরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট ভেঙে অবকাঠামো পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখনই তা বন্ধ না করলে এই ক্ষতি কোনোভাবেই পোষানো সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে চণ্ডীছড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপক চৌধুরী মুরাদ আহমেদ বলেন, প্রশাসন থেকে নিয়ম মেনে ইজারা নেওয়া হয়েছে। বালু পরিবহনের জন্য বকুল পালসহ অন্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দিলীপ কুমার বণিক প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে চা-বাগানের ভেতরে বালুমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ আছে। ছড়া পরিষ্কার ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য চণ্ডীছড়া চা-বাগান কর্তৃপক্ষকে অনুমোদন দেওয়া হয়। তারা বালু বিক্রি বা আইন অমান্য করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।