বিদায় নিসর্গসখা

শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক ও প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি স্ত্রী দেবী শর্মা, ছেলে সুমিত্র শর্মা, মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা ছাড়াও অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ও গুণগ্রাহী অনুসারী রেখে গেছেন।

তাঁর পারিবারিক সূত্রে বলা হয়েছে, গত ২৩ জুলাই তিনি রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসে সমস্যা ছিল। পরে তাঁর কিডনিতে গুরুতর জটিলতা দেখা দিলে ২৯ জুলাই তাঁকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পরও বারডেমে তাঁর অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটলে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর তাঁকে বারডেম হাসপাতাল থেকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এক দিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে দ্বিজেন শর্মার জীবনাবসান ঘটে। সেখানে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক মির্জা টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ ‘শক’ (ফল অব ব্লাডপ্রেশার) ও ‘সেফটিসেমিয়া’।

দ্বিজেন শর্মার স্বজনেরা জানিয়েছেন, তাঁর মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা আছে। তাঁর লন্ডনবাসী মেয়ে দেশে ফেরার পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে। তাঁকে শেষশ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

বাসস জানায়, দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন।

১৯২৯ সালের ২৯ মে তৎকালীন সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে দ্বিজেন শর্মার জন্ম। হাতেখড়ি, পাঠশালায় পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা পাথারিয়া পাহাড়ের অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশে, যার গভীর ছাপ তাঁর মনে আজীবন রয়ে গেছে। তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানের ডেমোনস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬০ সালে দেবী শর্মার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতার মাঝখানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। ওই কলেজের প্রাঙ্গণে তিনি অনেক গাছ লাগান, যার কিছু আজও রয়ে গেছে।

১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদক হিসেবে যোগ দিতে মস্কোয় যান।

এই প্রতিষ্ঠানে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০টি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। সমতা, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন; সমাজতন্ত্রের প্রতি
মুগ্ধতার টানেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ দুই দশক সে দেশে বাস করেছেন। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষক দ্বিজেন শর্মা তাঁর দীর্ঘ দুই দশকের সোভিয়েতবাসের অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি তুলে ধরেছেন সমাজতন্ত্রে বসবাস নামের এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ গ্রন্থে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপের পর ১৯৯৪ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং এই পর্বে আর অনুবাদ নয়, নিজের লেখালেখি বাড়িয়ে দেন। পত্রপত্রিকায় প্রকৃতি, পরিবেশ, বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ে তাঁর অনেক নিবন্ধ-প্রবন্ধ ছাপা হয়। তিনি বাংলায় নেচার রাইটিং বা প্রকৃতিবিষয়ক লেখালেখির অন্যতম পথিকৃৎ, নিসর্গসখা, বৃক্ষসখা, প্রকৃতিপুত্র ইত্যাদি বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা হয়। তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ-বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তরুপল্লব নামের একটি সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি; এই সংগঠনের আয়োজনে এক দশক ধরে তিনি তরুণ প্রজন্মকে গাছ চেনানোর কাজে তৎপর ছিলেন।

অনুবাদ ছাড়াও তিনি প্রায় ৩০টি বই লিখেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্যামলী নিসর্গ, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, সতীর্থবলয়ে ডারউইন, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস, সমাজতন্ত্রে বসবাস, বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ, জীবনের শেষ নেই, ফুলগুলি যেন কথা, গাছের কথা ফুলের কথা, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, গহন কোন বনের ধারে ইত্যাদি।

দ্বিজেন শর্মা এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রকল্পের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন।

মননশীল লেখালেখির জন্য তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ২০১৫ সালে।

প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার সারা জীবনের সাধনা ছিল প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগানো। শিক্ষকতা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড—তাঁর সকল সক্রিয়তার মূল প্রণোদনা ছিল প্রকৃতিপ্রেম। তিনি মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন; ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিকে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে দেখার ঘোর বিরোধী ছিলেন।