মোটা চালের কেজি ৫০ টাকায় উঠেছে

কুষ্টিয়ার খাজানগর এলাকার মেসার্স স্বর্ণা অটো রাইস মিল ঈদুল আজহার পরে প্রতি কেজি সরু মিনিকেট চাল বিক্রি করেছিল ৫৩ টাকা দরে। গতকাল শনিবার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৯ টাকা। ১০ দিনে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৬ টাকা। একই সময়ে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ টাকা। আর ঢাকায় প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় উঠেছে।

এরই মধ্যে আজ রোববার থেকে আগেরবারের চেয়ে দ্বিগুণ দামে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরু হচ্ছে। সারা দেশে খাদ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত ডিলাররা ৫২০টি ট্রাকে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করবেন। প্রতি কেজি আটা বিক্রি হবে ১৭ টাকা দরে। গত বছর এই চাল ১৫ ও আটা ১৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
ওএমএসে চালের দাম দ্বিগুণ করার কারণ জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমরা যখন ওএমএস চালু করি, তখন বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ৩০ টাকা। তাই মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আমরা ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করেছি। এখন বাজারে প্রতি কেজি চাল ৪৫ টাকা, তাই দাম বাড়ানো হয়েছে।’

মোটা চালের দাম বাড়ল
গতকাল ঢাকার দুই পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের আড়তে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা উঠেছে। অন্যদিকে, সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে। মাঝারি মানের বিআর ২৮ চালের দাম কেজিপ্রতি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে কখনোই মোটা চালের কেজিপ্রতি দর ৫০ টাকা ছাড়ায়নি। আবার ধানের দামও এত বেশি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন বিশ্ববাজারে চালের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ডলার হয়েছিল, তখনো ঢাকার বাজারে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকার আশপাশে ছিল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে সরবরাহে একটি ধাক্কা লেগেছে। চাল ব্যবসায়ীরা হয়তো মনে করছেন, কিছুদিন পরে যে মৌসুমটি আসবে, সেখানেও উৎপাদন কম হবে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারও চড়া। সরকারের উচিত এখন চালের সরবরাহ বাড়ানো।
গত বোরো মৌসুমে ফলন প্রায় ২০ লাখ টন কম হয়েছে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে দুই দফায় আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা ও বাকিতে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও দাম বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির গতকালের হিসাব
সরকারি সংস্থা টিসিবির গতকালের হিসাব

কুষ্টিয়ায় চালের মোকাম
কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে প্রায় ৫০০ ছোট-বড় চালকল রয়েছে, যা খাজানগর মোকাম হিসেবে পরিচিত। এসব চালকল থেকে দিনে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন চাল ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যায়। দেশের চালের বাজারে বড় ভূমিকা রাখে কুষ্টিয়া। এখন কুষ্টিয়া থেকে যাচ্ছে মূলত সরু ও মাঝারি চাল। আর ভারত থেকে আসছে মোটা চাল।
খাজানগরের চালকলের মালিকেরা বলছেন, বাজারে ধান মিলছে না। কিছু কিছু পাওয়া গেলেও দাম উঠেছে মণপ্রতি দেড় হাজার টাকায়। এ ধান কিনে চাল উৎপাদন করলে এখনকার দামেও পোষাবে না।
চাতালগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগই খালি। কিছু কিছু চাতালে ধান শুকাচ্ছেন শ্রমিকেরা। তবে কুষ্টিয়ায় বেশি উৎপাদনক্ষমতার ৩১টি আধুনিক প্রযুক্তির অটো রাইস মিল আছে, সেগুলো প্রায় সবই চলছে। সরু ও মাঝারি চাল মূলত এসব অটো রাইস মিলেই উৎপাদিত হয়।
স্বর্ণা অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপক জাকিউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে যে ধান আছে তা দিয়ে আর আড়াই মাসের মতো চলবে। এরপর মিল বন্ধ রাখতে হবে।’ চালের সরবরাহ কেমন এবং দর কী জানতে চাইলে তিনি খাতা খুলে দেখিয়ে বলেন, ‘আমরা পুরোনো কিছু সরবরাহ আদেশ অনুযায়ী চাল সরবরাহ করছি। এতে মিনিকেট চালের কেজি পড়ছে ৫৪ টাকা। নতুন আদেশে দর কেজিপ্রতি ৫৯ টাকা। পুরোনো আদেশ অনুযায়ী সরবরাহ শেষ না করে আমরা নতুন আদেশ খুব বেশি নিচ্ছি না।’
খাজানগরের বেশির ভাগ মিলেই এখন মোটা চাল নেই। ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মোটা চালের বাজার এখন ভারতের ওপর নির্ভর করছে। সেই চাল আসছে মূলত বেনাপোল বন্দর দিয়ে। ঈদের পরে বন্দর খোলার পর সেখানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা, যা গতকাল ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

চালকলের মালিকদের সভা ও অভিযান
চালের বাজারের অস্থির অবস্থার জন্য চালকলের মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন সরকারের দুজন মন্ত্রী। চালকলমালিকদের সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদের খাজানগরের মিলে অভিযানও চালানো হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আগামী মঙ্গলবার চালকলমালিকদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে মালিকদের অবস্থান কী হবে তা ঠিক করতে বগুড়ায় গতকাল বৈঠক করেছেন বিভিন্ন জেলার চালকলমালিক সমিতির নেতারা।
আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল বগুড়ায় বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগামী মঙ্গলবার সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠক সামনে রেখে চালকলমালিকেরা এ সভা করেন।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রশিদের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংগঠনের সারা দেশের শতাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, চালের মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধির জন্য একটি গণমাধ্যমের খবরই দায়ী। চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য কোনোক্রমেই চালকলের মালিকেরা দায়ী নন। একজন মিলের মালিকের চালকলের জন্য ১৫ দিনে যে ধান প্রয়োজন, তার পাঁচ গুণ ধান-চাল গুদামে মজুত করার বৈধতা রয়েছে।
আমাদের নাটোর প্রতিনিধি জানান, মজুত চালের বস্তায় উৎপাদন তারিখ না থাকায় নাটোরের দুটি চালকলকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল সকাল থেকে রাত অবধি বড়াইগ্রাম উপজেলার গড়মাটি এলাকার রশিদ অটো রাইস মিল ও বনপাড়ার গাজী রাইস মিলে অভিযান চালানো হয়। এ সময় রশিদ অটো রাইস মিলে চালের বস্তায় উৎপাদন তারিখ উল্লেখ না থাকায় ভোক্তা অধিকার আইনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।