দেশে বড় হচ্ছে জলবায়ুর প্রভাব

এবারের শরতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা ভরা বর্ষাকেও হার মানিয়েছে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
এবারের শরতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা ভরা বর্ষাকেও হার মানিয়েছে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঋতুচক্রে শরৎ নামলে শুরু হয় নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। মাঠজুড়ে সাদা কাশবন আর বিন্দু বিন্দু শিশিরের উঁকিঝুঁকি। বাংলায় শরৎ অনেক কাল ধরে এভাবেই ধরা দিত। কিন্তু গত কয়েক বছরে শরৎ আর বর্ষায় পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম আর ঝুমবৃষ্টিতে কেটেছে শরতের প্রায় পুরোটা সময়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব, এবারের শরতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা ভরা বর্ষাকেও হার মানিয়েছে। রাজধানীতে গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার মিলিয়ে ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত যদি কোনো পাত্রে রাখা হয়, তার উচ্চতা হবে প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার। মানে প্রায় ৬ ইঞ্চি। এই সময়ে এত বৃষ্টি খুব কম বছরই হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা।

তিন দিন ধরে চলা এই ঝুমবৃষ্টির আগে আবহাওয়া অন্য চেহারায় ছিল। টানা চার-পাঁচ দিন রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠা–নামা করেছে। সাধারণত গ্রীষ্মে এ ধরনের গরম অনুভূত হয়। কিন্তু এবার সেপ্টেম্বরের একটি বড় সময় ধরে প্রায় গ্রীষ্মের গরম অনুভূত হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার এই বদল শুধু এ বছর নয়, ৩০ বছর ধরে ঘটছে। দেশি-বিদেশি গবেষকেরা একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে, রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে আর বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুতও হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, অসময়ের এই বৃষ্টির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। শুধু বৃষ্টি নয়, বিশ্বের মতো বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রাও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই শতকের মধ্যে দেশের তাপমাত্রা গড়ে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লেই বছরে বোরো ও আমন ধানের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) আলাদা দুটি গবেষণায় দেশের বৃষ্টিপাতের ধরন বদলের চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত ক্রমাগত বাড়ছে। এতে ওই এলাকায় পাহাড়ধস বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে আসছে।প্রাকৃতিকভাবেই লবণাক্ত ওই এলাকায় বৃষ্টি কমায় পানি ও মাটির লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। ফলে ওই এলাকার ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি বিশ্বের আটটি দেশকে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে বিশেষ সতর্কবার্তা দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়া ও বড় বন্যার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছে এফএও। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থা ইউএসডিএ গত জুন মাসের বাংলাদেশের ফসল পরিস্থিতি নিয়ে করা প্রতিবেদনেও এ বছর ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছে।

এ বিষয়ে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জলবায়ু গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এত দিন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কথা বলতাম। হাওরে সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বন্যা হয়, এ বছর আমরা মার্চে ভয়াবহ বন্যা দেখলাম। দেশের উত্তরাঞ্চলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরজুড়ে যে বন্যা হলো, তাতে গত ১০০ বছরের মধ্যে পানির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি বাড়তে দেখেছি। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।’

বিপদে বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই শতকের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এর ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে বাংলাদেশে কী পরিমাণ উপকূলবাসী বাস্তুচ্যুত হবে, তা নিয়ে বুয়েটের ওই গবেষণায় নতুন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য এতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা এলাকার পরিমাণ কম। অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে হওয়া ওই গবেষণায় দেখা গেছে, এই শতকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়লে দেশের ৩ হাজার ৯৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ৪ শতাংশ এলাকা থেকে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইপিসিসির পূর্বাভাসটি দেওয়া হয়েছিল একটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলকে বিবেচনায় নিয়ে। মোটামুটি ধারণার ভিত্তিতে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে গত ৩০ বছরে বঙ্গোপসাগর ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর পানির উচ্চতা কী পরিমাণে বেড়েছে, তা হিসাব করেছি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে কী পরিমাণে বাড়তে পারে, সেই পূর্বাভাসের ভিত্তিতে গবেষণাটি করেছি।’

আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচের এ বছরের প্রতিবেদন বলছে, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ ১৮৫ বার চরম বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বিরূপ আবহাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু হওয়ার দিক থেকে তৃতীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।

চট্টগ্রামে বৃষ্টি বাড়ছে

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চলতি মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সন্দ্বীপে তো গত তিন দিনের মোট বৃষ্টিপাত ৪০০ মিলিমিটার অতিক্রম করে গেছে। কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিভাগের বেশির ভাগ স্থানে এই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের বৃষ্টিপাত এমন জলাবদ্ধতা তৈরি করল, যা জোয়ার-ভাটার সঙ্গে শহরের মানুষের জীবনকে আটকে ফেলেছিল। জুলাই-আগস্টের বেশির ভাগ সময় চট্টগ্রাম শহরের বড় অংশ প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। তবে সেপ্টেম্বর মাসের এই বৃষ্টি যে ব্যতিক্রম কিছু নয়, তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের করা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে করা সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে।

নরওয়ের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর গত বছর ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক একটি বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আবহাওয়ার রূপ বদল নিয়ে করা ওই গবেষণায় বর্ষায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত টেকনাফের বৃষ্টিপাত ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় বৃষ্টিপাত যথাক্রমে ১৫ ও ১০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে কক্সবাজারের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় ২০ শতাংশ, ফেনীতে ২৫ শতাংশ ও মাদারীপুরে মোট বৃষ্টিপাত ২৮ শতাংশ কমে গেছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) গবেষক আবু সৈয়দ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেন। দেশে গত ৩০ বছরের বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার পরিবর্তন তুলে ধরে তিনি দেখান, প্রাকৃতিকভাবেই লবণাক্ত এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে শুষ্কমৌসুমে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এতে ওই এলাকায় লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। বর্ষায় যেখানে উপকূলের ১০ শতাংশ এলাকা লবণাক্ত থাকে, সেখানে শীতকালে তা বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক গবেষণার অন্যতম গবেষক বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত বেড়ে গেলেও রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় আমরা বৃষ্টিপাত কমে যেতে দেখছি। একই সঙ্গে অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে। আর বছরের বাকি সময়ে আবহাওয়ায় স্বাভাবিক অবস্থায় থাকছে।’

ওই দুই গবেষণার ফলাফল ও পূর্বাভাসের প্রমাণ অবশ্য দেশের চলমান বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পাওয়া গেছে। তাপ ও বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কক্সবাজার ও টেকনাফের অপরিকল্পিত হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণ।

নতুন বিপদ বজ্রপাত

এ বছর তো প্রকৃতির এমন এক বৈরিতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেল, যা এত দিন দুর্যোগ হিসেবেই স্বীকৃতি পায়নি। এ বছর নতুন দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বজ্রপাতে মারা গেছে ১৭০ জন। গত সাত বছরে দেশে শুধু বজ্রপাতেই মারা গেছে ১ হাজার ৭৬০ জন।

গত বছর বিশ্বখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কোথাও তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। গত ৩০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে ১ ডিগ্রি বেড়ে গেছে, ফলে বজ্রপাতও বাড়ছে।

এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বজ্রপাত গবেষক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়লে মেঘের মধ্যে তাপ ধারণক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে বজ্রপাতও বাড়ে। বাংলাদেশে গত এক যুগে বজ্রপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে বলে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে অন্যতম কারণ হিসেবে আমাদের মনে হয়েছে।’

তবে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের সদস্যসচিব গওহার নঈম ওয়ারার মতে, আগে দেশে বড় বৃক্ষের পরিমাণ বেশি ছিল। ফলে বজ্রপাত হলে তা গাছের মধ্যে পড়ত। বেশির ভাগ ভবনে বজ্রপাত-নিয়ন্ত্রক দণ্ড থাকত। এখন তা অনেক কমে গেছে। ফলে বজ্রপাত গিয়ে সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত হানছে।

১০০ বছরে বড় বন্যা

এ বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে গেছে। গত এপ্রিল-মে মাসে হাওরের বাঁধভাঙা বৃষ্টির কারণে বোরোর ফসল আগেই মার খেয়েছিল। বন্যায় আমনের ক্ষতি এর সঙ্গে যোগ হয়ে চালের বাজার অস্থির করে তুলেছে। দেশে ফসলের ক্ষতির কারণে এখন বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির জন্য ঘুরতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা নতুন কিছু নয়। তবে এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে। সেটা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা এখন যেভাবে রাস্তা বানাই, বাঁধ তৈরি করি, তা স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হলে আমাদের আইনের শাসনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে পরিকল্পনা করতে হবে।’

ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে ঘন ঘন

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বাংলাদেশে। ১৯৭১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি চার থেকে পাঁচ বছর পরপর বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানত। ২০০৭ সালের পর প্রতি দুই বছর পরপর দেশে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।

আবু সৈয়দের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি বাড়লে সেখানে গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগরে এপ্রিল ও মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার হার বেড়ে গেছে। ফলে প্রায় প্রতিবছরই সেখানে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। ২০০৭ থেকে একে একে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু ও মোরা বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। বড় ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে বিরতির পরিমাণ কমে আসছে।

পাহাড়ধসের পেছনেও জলবায়ুর পরিবর্তন

এক যুগ ধরে দেশে ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ধস বাড়ছে। আগে বেশির ভাগ ধসের ঘটনা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ঘটত। চলতি বছর দেশের তিন পার্বত্য জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধস হয়। তিন পার্বত্য জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ১৫৬ জন।

গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা ও বসতি স্থাপনকে মূলত দায়ী করছেন। পাহাড়ের ভূমিবিন্যাস ও বুননকে বিবেচনায় না নিয়ে সড়ক নির্মাণের কারণেও ধস বেড়েছে বলে অনেকে মত দিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে জলবায়ু গবেষক আবু সৈয়দ প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অধিক তাপে সেখানকার মাটির বুনন আলগা হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্ষায় বৃষ্টি বেড়ে সেখানে ধস বাড়ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ওই ধসকে ত্বরান্বিত করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তিন পার্বত্য জেলায় সামগ্রিকভাবে বৃষ্টিপাত বাড়ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। আবার বর্ষার আগে তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই পাহাড়ধসের আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

সামগ্রিকভাবে দেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বিষয়ে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) উপনির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন আমরা যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সময় আগের ৩০ বছরে কী হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু আমরা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলার বিষয়টিকে মাথায় রেখে এর নকশা তৈরি করেছি। দেশের শহরের জলাবদ্ধতা, গ্রামে সেতু-সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ওই প্রভাবকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।’