পৃথিবীটা অনেক বড়

প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল কেক কেটে কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল কেক কেটে কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা l ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে যখন বিকেল, আমেরিকার টেনেসিতে ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। এ সময়ে কারও জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি জেগে আছি। বাংলাদেশ থেকে ফোন আসবে। প্রথম আলোর কার্যালয়ে জড়ো হয়েছে কিশোর-কিশোরীরা। কিশোর আলোর চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হবে। ভিডিওকলের মাধ্যমে আমিও যোগ দেব তাদের সঙ্গে।

ঠিক সময়ে ফোন এল। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে এল কয়েক শ ছেলেমেয়ের উচ্ছল চিৎকার। ছেলেমেয়েগুলোর হাসিমুখ ভুলিয়ে দিল দূরত্ব। মনে হলো, আমি বাংলাদেশেই আছি। আমার প্রিয় কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। উদ্‌যাপন করছি কিশোর আলোর জন্মদিন।

প্রযুক্তি ছাড়া এই অসাধারণ ব্যাপারটি সম্ভব হতো না। পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনেছে প্রযুক্তি। ঘুচিয়েছে দূরত্ব। কিন্তু এই প্রযুক্তিই চিন্তার ভাঁজ ফেলছে আমাদের কপালে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বুঁদ হয়ে আছে মুঠোফোনে। ট্যাবের স্ক্রিনে।
রাতের আকাশের তারা বিস্মিত করছে না তাদের। একটা পাখি কিংবা নদীর ঢেউ তাদের দোলা দিচ্ছে না, যতটা দিচ্ছে কোনো একটা মোবাইল গেম। পৃথিবীটাই যেন ছোট হয়ে আসছে, বন্দী হচ্ছে চার দেয়ালে, চারকোনা বাক্সে।

এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্যই কিশোর আলো নামের পত্রিকাটি প্রতি মাসে বের করছি আমরা। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করেছিল কিশোর আলো। এবার পাঁচ বছরে পা দিল জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকাটি। এটি প্রকাশিত হয় প্রতি মাসের ৫ তারিখে। সারা দেশ থেকে অসংখ্য চিঠি, ফোন, ই-মেইল পাই আমরা। ছেলেমেয়েরা জানায়, তাদের ভালো লাগা না-লাগা, চাওয়া-পাওয়া। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন ভাবিনি এতগুলো কিশোর-তরুণ প্রাণকে ছুঁয়ে যেতে পারবে কিশোর আলো। অবাক করা ব্যাপার হলো, চার দেয়ালের গণ্ডি থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসছে ছেলেমেয়েরা। তারা এখন গল্প-কবিতা-ছড়া লিখছে। সেগুলো ছাপাও হচ্ছে কিশোর আলোতে। ছেলেমেয়েরা মিলে তৈরি করেছে কিশোর আলো ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাব। ক্লাবের সদস্যরা প্রতি মাসে তৈরি করছে তাদের শর্ট ফিল্ম। ইউটিউব, ফেসবুকে আপলোড হওয়ার পর মানুষ পছন্দও করছে সেগুলো। এই ছেলেমেয়েগুলো যে দারুণ দারুণ সব চলচ্চিত্র উপহার দেবে বাংলাদেশকে, সে আশা তো আমরা করতেই পারি।

আমরা জানি, মানুষকে গড়ে তোলে মানুষ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অসাধারণ একটা কাজ করছেন। বই পড়িয়ে আলোকিত করছেন সারা দেশের শিশু-কিশোরদের। কিন্তু তিনিও তাঁর অনেক বক্তৃতায় বলেছেন, এমন আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। কিশোর আলোর পাঠকেরাও জানে সেটা। তাই সারা দেশে বুকক্লাব তৈরি করেছে তারা। প্রতি মাসেই বাড়ছে বুকক্লাবের সংখ্যা। মাসে একবার তারা এক হয় তাদের স্কুল বা নির্দিষ্ট জায়গায়। বই নিয়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা। কাঁচা হাতেই বইয়ের রিভিউ লেখা এই ছেলেমেয়েদের ভেতর থেকেই হয়তো ভবিষ্যতের সৈয়দ শামসুল হক বা হ‌ুমায়ূন আহমেদকে খুঁজে পাব আমরা।

প্রযুক্তি থেকেও পিছিয়ে নেই কেউ। আছে কিশোর আলো প্রোগ্রামিং ক্লাব। প্রোগ্রামিংয়ের নিত্যনতুন কৌশল শিখছে কিশোর-কিশোরীরা। ভবিষ্যতে এদের হাত ধরেই হয়তো বেরিয়ে আসবে গুগল, ফেসবুকের চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান।

কিশোর আলোর সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্কটা শুধু পাঠক আর পত্রিকায় সীমাবদ্ধ নেই। ‌‘কিআ’কে নিজেদের একটা জায়গা বলেই মনে করে তারা। স্কুলের বন্ধুরা মিলে ছোট পরিসরেই হয়তো গান করে একদল কিশোর। তারা চলে আসে কিশোর আলোর মাসিক সভায়। তাদের মতোই একঝাঁক কিশোর-কিশোরীর সামনে গায় নিজেদের গান। অনুপ্রাণিত হয় অন্য কিশোরেরাও। আমরাও তা-ই চেয়েছিলাম, কিশোর আলো যেন কিশোরদেরই হয়।

দেশ থেকে অনেক দূরে বসেও আমি দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠি নতুন প্রজন্মকে নিয়ে। নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণেরা। তাদের পৃথিবীটা আর ছোট নেই। বরং দিনে দিনে বড় হচ্ছে আরও। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কিশোর আলোও বলে, ‘আমার পৃথিবী অনেক বড়’।