চম্পা বিবির সেই চম্পক বন

চম্পা বিবি। ছবি : আসাদুজ্জামান
চম্পা বিবি। ছবি : আসাদুজ্জামান

পলিথিনের বেড়া, এরই ছাউনি। পরবাসে এটাই গুল চম্পা বিবির মাথা গোঁজার ঠাঁই। বয়স তাঁর আশির কাছাকাছি। ঘরের মাটির মেঝেতে যখন শুয়ে থাকেন, তখন তাঁর স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা নিজের ঘরের ছবি। চারপাশে সবুজ গাছের সমারোহ। এর মধ্যে বাঁশের তৈরি দুটি মজবুত ঘর। যার ছাউনি টিনের।
ঘরের ভেতর শোয়ার দামি খাট, পাশে বেতের চেয়ার-সোফাসেট। এমনই ঘরে তিনি ঘুমাতেন। গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়ার পর এক মুহূর্ত দেরি না করে পরনের কাপড়েই ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। পরদিন খবর পান, তাঁর সেই ঘর আর নেই। সেনাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ভস্ম! মিয়ানমারের রাখাইনের তুমব্রু এলাকার এই নারী তাঁর জীবনের গল্প এভাবেই বর্ণনা করেন। এখন আছেন উখিয়ার থ্যাংখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। তাঁর সঙ্গে কথা হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে।

গুল চম্পা বিবির প্রায় সময় বাবা মতিউর রহমানের কথা মনে পড়ে। যখন তাঁর বয়স ৪০, তখন তিনি বাবাকে হারান। বিয়ের আগে বাবা কতবার শুনিয়েছেন তাঁদের পূর্বপুরুষদের কথা। বিশেষ করে দাদা আবদুল্লাহর কথা। যখন তিনি বুঝতে শেখেননি, তখন দাদা মারা যান। চাষাবাদ করে তিনি সংসার চালাতেন। গোয়ালে তাঁর সব সময় থাকত ২০-৩০টি গরু-মহিষ। কিন্তু তাঁর ছিল অনেক বুদ্ধি। মাতবর হিসেবে লোকে তাঁকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। মানুষের আপদে-বিপদে পাশে থাকতেন। তাঁর বাবা মতুরোহানও ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান। এলাকার মধ্যে তাঁর সবচেয়ে বেশি জমি ছিল। তিনিও এলাকার গরিব মানুষদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে গুল চম্পা বিবির ধারণা, পাঁচ শতাধিক বছর আগে থেকে তাঁর পূর্বপুরুষেরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন।

বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত গুল চম্পা বিবি। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। সব মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন ছেলের কাছেই থাকেন। দেখাশোনা সে-ই করে থাকে। ছেলের হাত ধরে এসেছেন বাংলাদেশে। এর আগে তিনি কখনো বাংলাদেশে আসেননি। পায়ের গোড়ালিতে সমস্যার কারণে ভালোভাবে হাঁটতে-চলতে পারেন না। খুব কষ্ট হয়। মেরুদণ্ডেও ব্যথা আছে। যখন তিনি মিয়ানমারে নিজের বাড়িতে থাকতেন, তখনো খুব একটা বাড়ির বাইরে যেতেন না। অথচ ১৫ দিনে পাহাড়, জঙ্গল, নদী-নালার কিনার দিয়ে কত পথ যে তিনি হেঁটেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশ-যাত্রার সেই বর্ণনা গুল চম্পা বিবির ভাষায়, ‘বেশি দুঃখ করে কষ্ট করে আসছি। আমার তো বেশি ব্যারাম। আমি তো হাঁটতে পারি না।’ অর্থাৎ তিনি অনেক রোগে ভুগছেন। আর অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে এসেছেন।

বাংলাদেশে আসার পর তাঁর শরীর আরও খারাপ হয়েছে। এখন শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা। মুখ ফুলে গেছে। মেরুদণ্ডের ব্যথা আরও বেড়েছে। মাথা সব সময় ঝিমঝিম করে। মাঝেমধ্যে অসহ্য যন্ত্রণাও হয়। এত বছর বয়সে এমন পরিবেশে তাঁকে থাকতে হবে, তা তিনি কোনো দিন ভাবেননি। এখন আর কিছুই তাঁর ভালো লাগে না। বেশির ভাগ সময় পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া প্রিয় স্বজনদের কথা মনে পড়ে, যাঁরা যুগ যুগ ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছেন। যাঁরা এখন শুয়ে আছেন মিয়ানমারের মাটিতে। তাঁদের প্রিয় জন্মভূমিতে। গুল চম্পা বিবিও ফিরে যেতে চান প্রিয় মাতৃভূমিতে। সেখানেই মরতে চান। কবরও যেন তাঁর সেখানেই হয়।

জীবনের শেষ বেলায় মিয়ানমারের নিজের বাড়িতে কাটানোর স্বপ্নে বিভোর গুল চম্পা বিবির মনে প্রশ্ন, কেন রাখাইন সেনারা তাঁর ঘর, তাঁদের ঘর, তাঁদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। নিরীহ লোকদের গুলি, জবাই করে হত্যা করল?
কী অপরাধ তাঁদের? যুগের পর যুগ তাঁদের পূর্বপুরুষেরা রাখাইন রাজ্যে বাস করে আসছেন। রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর চেয়ারে। দরজার সামনে বসে গুল চম্পা বিবি দেখেন, উখিয়ার বালুখালীর পাহাড়ে পাহাড়ে শত শত রোহিঙ্গার পলিথিনের তৈরি ঘর। এসব ঘর দেখে তাঁর মনে পড়ে ফেলে আসা তাঁর প্রিয় জন্মভূমির কথা, যেখানে কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর আর বাকিটা সময়। স্বপ্ন দেখেন, আবার কি তিনি সেখানে ফিরে যেতে পারবেন? চিরঘুম ঘুমাতে পারবেন?