শাকসবজিতে ঢুকছে রোগজীবাণু

হাঁস-মুরগির খামারের বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। গবেষকেরা শাকসবজিতে দুটি রোগের জীবাণু শনাক্ত করেছেন, যার উৎস অপরিশোধিত পোলট্রি বর্জ্য। দেশে পোলট্রি-শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটলেও এর বর্জ্য শোধনের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের গবেষকেরা ময়মনসিংহের পাঁচটি কৃষি খামারের করলা, গাজর, বেগুন, লাউ, শসা, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, মরিচ ও ঝিঙায় সালমোনেল্লা ও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেছেন। খামারগুলোতে সার হিসেবে পোলট্রি খামারের অপরিশোধিত বর্জ্য ব্যবহার করা হয়। এই গবেষণার ফলাফল গত মাসে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত নবম ওয়ান হেলথ বাংলাদেশ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সালমোনেল্লার কারণে টাইফয়েড ও ই-কোলাইয়ের কারণে ডায়রিয়া হয়। অপরিশোধিত পোলট্রি বর্জ্য খেত-খামারে সার হিসেবে বা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। অন্যদিকে কাঁচা শাকসবজি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

দেশে হাঁস-মুরগির খামার বা পোলট্রি-শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। শিল্পটি ইতিমধ্যে অনেক বড় হয়েছে। এই শিল্পের বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো নীতিমালা বা আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। পোলট্রি বর্জ্য খামারের পাশে, নদীতে, জলাশয়ে, রাস্তার পাশে ফেলা হচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

প্রধান গবেষক মানসী মোদক প্রথম আলোকে বলেন, এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল্যায়ন, পরিবেশ ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং শাকসবজিতে জীবাণুর উপস্থিতি বিশ্লেষণ করা। সেটি সফলভাবে করা সম্ভব হয়েছে।

এই গবেষক বলেন, ‘পোলট্রি বর্জ্যের কারণে নানা বিষক্রিয়া দেখা দেয়। কাঁচা মরিচ, গাজর, শসা—এসব আমরা কাঁচা অবস্থায় খাই। তাই এসব কাঁচা খাওয়ার আগে ভালো করে ধোয়া উচিত।’

এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, পোলট্রি বর্জ্য মূল্যবান সম্পদ। পরিশোধন করলে মাছের মূল্যবান খাবার ও কৃষির জন্য উপযুক্ত সার হতে পারে। তবে পরিশোধন না করলে এই বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করে। এ বিষয়ে আইন করে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গবেষণাপদ্ধতি

ময়মনসিংহ সদর ও ত্রিশাল উপজেলার ৩৬টি মুরগির খামার নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। এসব খামারের বর্জ্য ব্যবহৃত হয় এমন কৃষি খামার থেকে ১৯টি শাকসবজির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বর্জ্য ফেলা হয় এমন জমির মাটি ও পুকুরের পানির নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগে পরীক্ষা করা হয়।

গবেষকেরা বলছেন, মালিকদের ৬৯ শতাংশের হাঁস-মুরগি পালনের ওপর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাঁরা পোলট্রি বর্জ্যের ক্ষতিকর বিষয়ে সচেতন নন। ৩১ শতাংশ মালিক বর্জ্য পুকুরে ফেলেন, ১৬ শতাংশ মালিক সরাসরি কৃষিজমিতে ফেলেন, ৩ শতাংশ মালিক বায়োগ্যাস তৈরি করেন। ৮১ শতাংশ মালিক বর্জ্য ফেলার আগে পরিশোধন করেন না।

শাকসবজির নমুনা পরীক্ষায় ১০টি নমুনায় সালমোনেল্লা পাওয়া গেছে। আর ৮টি নমুনায় সালমোনেল্লা ও ই-কোলাই দুটিই পাওয়া গেছে। বায়োগ্যাস তৈরি হয়েছে এমন নমুনায় জীবাণু পাওয়া যায়নি। মাটির তিনটি নমুনার মধ্যে দুটিতে সালমোনেল্লা ও একটিতে ই-কোলাই পাওয়া গেছে। পুকুরের পানির দুটি নমুনার মধ্যে একটিতে সালমোনেল্লা ও অন্যটিতে ই-কোলাই পাওয়া গেছে।

গবেষকেরা বলছেন, বর্জ্য জমিয়ে রাখতে হবে এবং সার তৈরির পর ব্যবহার করতে হবে। পোলট্রি বর্জ্য ফেলা হয় এমন পুকুরের পানি শাকসবজিতে সেচে ব্যবহার করা যাবে না।

সরকার কী করছে

বাংলাদেশ পোলট্রি ফার্মস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পোলট্রি বর্জ্য পরিবেশের ক্ষতি করে এবং রোগ ছড়ায়। কিন্তু নতুন শিল্প বলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের বিষয়গুলো গুরুত্ব কম পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছি নতুন খামারের অনুমোদন দেওয়ার সময় বর্জ্য পরিশোধনের বিষয়টি যেন নিশ্চিত করা হয়। আর পরিদর্শনের সময় পুরোনো খামারগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে।’

পোলট্রি ফার্ম অনুমোদন দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আয়নাল হক বলেন, ‘আমরা লোকালয় থেকে দূরে খামার করার কথা বলি। কিন্তু এটি বিকাশমান নতুন শিল্প হওয়ার কারণে বর্জ্য শোধনকে এখনো বাধ্যবাধকতার আওতায় আনা হয়নি। তবে তা আনার চিন্তা আছে।’