তর্ক করায় গুলি করলেন নেতা!

পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে আটকের প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন তাঁর অনুসারীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় তোলা ছবি l প্রথম আলো
পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে আটকের প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন তাঁর অনুসারীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় তোলা ছবি l প্রথম আলো

সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। সিনেমার দৃশ্যের মতোই, তর্কের একপর্যায়ে প্রথমে ব্যবসায়ীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। একটু পর নিজের গাড়ি থেকে পিস্তল বের করে ওই ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি করেন তিনি। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীদের। গত শনিবার রাত ১১টায় চট্টগ্রাম অফিসার্স ক্লাবের গেটের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনার পরপরই পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। গতকাল রোববার সকালে বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মী এবং পরিবহনশ্রমিকেরা সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা পৌনে একটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম-রাঙামাটির সড়কের পাঁচ জায়গায় অবরোধ করেন। এতে দুর্ভোগে পড়ে হাজারো মানুষ। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একাধারে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। নাম মঞ্জুরুল আলম। তাঁর ঠিকাদারি ব্যবসাও রয়েছে।
যে ক্লাবের সামনে মঞ্জুরুল আলম এ ঘটনা ঘটান, সেই অফিসার্স ক্লাবেরও যুগ্ম সম্পাদক তিনি। আর গুলিবিদ্ধ ঢেউটিন ব্যবসায়ী এস এম জয়নাল উদ্দিন চৌধুরী একই ক্লাবের সমাজসেবা সম্পাদক।
চট্টগ্রাম অফিসার্স ক্লাবটি নগরের আউটার স্টেডিয়ামের পাশে। সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা এই ক্লাবের সদস্য। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ক্লাবে একজন অতিথির প্রবেশ করা নিয়ে জয়নালের সঙ্গে তর্কে জড়ান মঞ্জুরুল। ওই অতিথির পরিচয় নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তাঁরা। ক্লাবের সদস্য হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শীরা নিজেদের নাম প্রকাশ হোক তা চাননি।
আটকের পর থেকে গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘণ্টা মঞ্জুরুল আলম চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁর খাবার কোথা থেকে এসেছে তা বলতে পারেনি পুলিশ। গতকাল রাত আটটায় থানায় ওসির কক্ষে দর্শনার্থীদের চেয়ারে বসে মঞ্জুরুল আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ব্যবসায়ী জয়নাল একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে ক্লাবের ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করেন। তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে প্রথমে গালমন্দ করেন জয়নাল। একপর্যায়ে ক্লাবের রান্নাঘর থেকে বঁটি দা নিয়ে এসে তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা করেন। তখন অত্মরক্ষার জন্য নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাঁর পায়ে গুলি করেন তিনি।
মঞ্জুরুল আলমকে আটকের পর গতকাল দুপুর থেকে তাঁর অনুসারী কর্মীদের পাশাপাশি পরিবহন মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতারা থানায় ভিড় জমান। গত রাত আটটায় থানার ভেতরে এবং বাইরে অন্তত দেড় শ ব্যক্তি ছিলেন।
এদিকে গুলিতে আহত জয়নাল উদ্দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁর বাঁ পায়ের আঙুলে গুলি লেগেছে। হাসপাতাল থেকে শনিবার মধ্যরাতের পর তিনি বাসায় ফিরে যান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে মঞ্জুরুল আমাকে ঘুষি মারে। এরপর গাড়ি থেকে পিস্তল এনে গুলি করে।’ তিনি বলেন, ‘মঞ্জুরুলের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। নইলে আরও অঘটন ঘটবে।’
এদিকে গতকাল সকাল আটটা থেকে মঞ্জুরুলের অনুসারী দলীয় নেতা-কর্মী এবং পরিবহনশ্রমিকেরা চট্টগ্রাম-রাঙামাটি এবং চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের হাটহাজারীর বড়দীঘি পাড়, চৌধুরী হাট, হাটহাজারী সদর, ফটিকছড়ির ঝংকার মোড় ও সদর এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সড়কের ওই পাঁচটি এলাকায় শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। চরম দুর্ভোগের শিকার হয় হাজারো যাত্রী।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে হাটহাজারী সদর উপজেলা অংশে সড়কের ওপর বেশ কয়েকটি বাস এলোমেলোভাবে পার্ক করে রাখা হয়। এতে সড়কের দুই দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। এ সময় অনেকে বাস থেকে নেমে চট্টগ্রাম নগরের দিকে হাঁটতে থাকেন। হাটহাজারী থেকে চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন মোড়ের বাস টার্মিনাল এলাকার দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার।
বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন মোড়ে বাস টার্মিনাল থেকে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি যেতে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে আসেন নবী কালাম। অবরোধের কারণে তাঁরা আটকা পড়েন।
দুপুর ১২টায় বড়দীঘির পাড়ে কথা হয় চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়িগামী বাসের যাত্রী শফিকুল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন মোড় থেকে বাস ছেড়ে চার কিলোমিটার আসার পর বড়দীঘিপাড়ে তাঁদের বাস আটকে দেওয়া হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বাসে বসে রয়েছেন তাঁরা।
সড়ক অবরোধের বিষয়ে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বেলাল উদ্দিন গতকাল বেলা আড়াইটায় প্রথম আলোকে বলেন, সকালে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির কয়েকটি জায়গায় সড়ক অবরোধ করেন নেতা-কর্মীরা। তাঁরা অবরোধকারীদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে সড়কে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে।
তবে চট্টগ্রাম নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি বাস মিনিবাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঞ্জুরুল আলম সড়কের অবরোধ তুলে নিতে বলেছেন, তাই অবরোধ তুলে নিয়েছি।’
গুলিবিদ্ধ জয়নালের ভাই এস এম আলমগীর চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য। তিনি আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগেরও নেতা। আলমগীর চৌধুরী বলেন, গত রমজান মাসেও মঞ্জুরুল তাঁর ভাইকে মারধর করেছিলেন। গুলির ঘটনায় তাঁরা পুলিশকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সমঝোতা করা হবে না বলে জানান তিনি।
অভিযোগ পাওয়ার পরও কেন মামলা নিচ্ছেন না জানতে চাইলে গত রাত সাড়ে আটটায় কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
গত রাত পৌনে ১১টায় চট্টগ্রামের উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স করা অস্ত্র থেকেই গুলিটি বের হয়। এক পক্ষ গুলির ঘটনাটিকে বলেছে ভুল-বোঝাবুঝি। আরেক পক্ষ প্রথমে এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ ছিল। পরে দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে পুলিশকে মামলা না নিতে অনুরোধ করে। যে কারণে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে আপাতত কিছু করছে না। আটকের ২১ ঘণ্টা পর মঞ্জুরুল আলমকে রাত নয়টার দিকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে গুলির ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে।