কাটাসুর, রামচন্দ্রপুর খাল এখনো বাঁচানো সম্ভব

নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এখনো প্রবহমান রামচন্দ্রপুর খালের এই অংশ। ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের সদিচ্ছাই পারে পুরো খালের এই রূপ দিতে। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এখনো প্রবহমান রামচন্দ্রপুর খালের এই অংশ। ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের সদিচ্ছাই পারে পুরো খালের এই রূপ দিতে। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

বাঁধাই করা পাড় সবুজে মোড়া। খালে টলমলে পানি। তার ওপর ঢেউখেলানো বাতাস। ঢেউয়ের তালে দোলে ঘাটে বাঁধা ছোট ডিঙি। দুই পাড়ের খোলা জায়গায় বাসিন্দাদের আয়েশি চলাফেরা। শিশু-কিশোরদের কলরব। পাড় ধরে সকাল-বিকেল হাঁটতে হাঁটতে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া।
এটি রায়েরবাজার-মোহাম্মদপুর এলাকার কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খাল ও এর দুই পাড়ে থাকা বাসিন্দাদের নিয়ে কল্পনাবিলাস। বাস্তবে এমনটি পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র। এই দুই খালের বড় অংশে পানি আছে সত্য, কিন্তু তা টলমলে নয়। কুৎসিত কালো রং; গা ঘিনঘিন করে। পচে যাওয়া আবর্জনা থেকে বাতাস উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। খাল দুটির দুই পাশে যাদের বাস, তারা বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারে না। নাক চেপে দিন কাটায়।
দখল, ভরাটে সংকুচিত হলেও খাল দুটির এখনো কিছু গভীরতা আছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের অসচেতনতা আর ওয়াসার নিষ্ক্রিয়তায় খাল দুটির পানি চলে থেমে থেমে, কোথাও পানি আটকে যায় মাটি আর আবর্জনার ভাগাড়ে।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, এই খাল দুটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সম্পূর্ণ উদ্ধার করে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করলে এই খাল দুটিকে দেওয়া যেতে পারে প্রতিবেদনের শুরুতে দেওয়া কাল্পনিক রূপ। আর জলাবদ্ধতা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে পারেন এই দুই এলাকার কয়েক লাখ লোক। খাল দুটি এখনো বাঁচানো সম্ভব।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রায়েরবাজারের পুলপাড় থেকে ২০-২৫ ফুট প্রস্থের একটি খাল পশ্চিম কাটাসুর হয়ে বছিলার দিকে চলে গেছে। এলাকার নাম অনুসারে খালটির এই অংশের নাম কাটাসুর খাল। বছিলা সড়কের নিচ দিয়ে উত্তরে গিয়ে খালটি মিশেছে রামচন্দ্রপুর খালের সঙ্গে। এরপর রামচন্দ্রপুর খালটি সাত মসজিদ হাউজিং, স্বপ্ননীড় হাউজিং, মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় বাজার, শেখেরটেক, শ্যামলী হাউজিং হয়ে আদাবর ১৬ নম্বরে গিয়ে মিশেছে কল্যাণপুর খালের সঙ্গে।
কাটাসুর খালের সুর আসলেই কেটে গেছে। পুলপাড় এলাকায় খালের দুপাশ বাঁধাই করা ঠিকই, কিন্তু পানি একেবারেই স্থির। তাতে ভাসছে পলিথিন, বোতল, খাবারে উচ্ছিষ্টসহ বারোয়ারি আবর্জনা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পয়োনিষ্কাশন নালার নোংরা পানি। পানির রং স্বাভাবিকভাবেই কুচকুচে কালো। সঙ্গে পচা আবর্জনার উৎকট গন্ধ গা গুলিয়ে দেয়। তথাকথিত বাঁধাই করা পাড় ঘেঁষে সারি সারি টিনের খুপরি।
এই এলাকায় ২৪ বছর ধরে থাকেন মামুন হোসেন। তিনি বলেন, যেভাবেই থাকুক, এই খাল থাকায় এখনো পুলপাড় এলাকায় জলাবদ্ধতা হয় না। খালের গভীরতা বেশি না। তাই পানিতে খাল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ক্ষীণ যে প্রবাহ এখনো চালু আছে, তা কোথাও বড় বাধা পেলেই উপচে যাবে দুই কূল। মামুন আরও বলেন, গত এক বছরের মধ্যে খালটি কখনো পরিষ্কার করতে দেখেননি তিনি।
খালের পাড় ধরে পুলপাড় থেকে পশ্চিম কাটাসুর, কাদেরাবাদ হাউজিং ও বছিলা সড়কের দক্ষিণ পর্যন্ত হেঁটে দেখা গেছে, পুরো খাল আবর্জনায় প্রায় ঢাকা। পানি গতিহীন। খালের ওপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে একাধিক কালভার্ট। সেগুলো নিচু ও সরু। আবর্জনা ও খালের তলায় জমা মাটির কারণে পানি কালভার্টের পেট ছুঁই-ছুঁই।
খালটি বছিলা সড়কের নিচ দিয়ে উত্তরে চলে গেছে। এখান থেকেই রামচন্দ্রপুর খালের শুরু বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান। এখানে খালের পানিতে বেশ গতি। আবর্জনার দু-একটি টুকরা ছাড়া খালের এই অংশ তুলনামূলক পরিষ্কার, তবে পানি যথারীতি নোংরা-কালো, দুর্গন্ধময়।
রামচন্দ্রপুর খালের শুরুর অংশটি সাত মসজিদ হাউজিংয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে স্বপ্ননীড় হাউজিং ও মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডের দিকে। খালের সাত মসজিদ হাউজিং অংশের শুরুতে দেখা গেল আধা পাকা ছোট অনেকগুলো ঘর। সে ঘর থেকে এক নারীকে খালে ময়লা ছুড়ে ফেলতে দেখা গেল।
সাত মসজিদ ও স্বপ্ননীড় হাউজিংয়ের মাঝামাঝি এলাকায় খালটি স্বপ্ননীড় হাউজিংয়ের একটি অংশ ছুঁয়ে গেছে। সেখানকার এক দোকানি মো. সজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস দু–এক আগে ওয়াসার লোকজনকে খালে পড়ে থাকা আবর্জনা তুলতে দেখেছি। এতে পানির প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে খালের তলায় যে মাটি জমেছে, তা পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে স্বপ্ননীড় এলাকায় এখনো বৃষ্টি হলে পানি জমছে।’
সেখান থেকে খালটির পাড় ধরে মোহাম্মদী হাউজিংয়ের দিকে যাওয়ার পথে দেখা হয় ওয়াসার চার-পাঁচজন কর্মীর সঙ্গে। তাঁরা খাল ঘুরে দেখছিলেন। খালের কোন পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়েছে, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, পুরো খালটিই পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু মোহাম্মদী হাউজিংয়ের এক নম্বর সড়ক থেকে তিন নম্বর সড়কের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে তৈরি করা প্রতিটি সেতুর দুই পাশে বারোয়ারি আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেল।
মোহাম্মদী হাউজিংয়ের ৭ নম্বর সড়কের বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, পুরো খালটির দুই পাশ ঘিরে বসতবাড়িগুলো যেন খালকে চেপে ধরেছে। আর স্থানীয় অনেকে আবর্জনা ফেলছেন খালে।
একই এলাকার আবদুর রহমান বলেন, আবর্জনা খালে ফেললে প্রয়োজনে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে খালটি ধীরে ধীরে ভরে যাবে। যারা এখন ময়লা ফেলছে, তারাই একদিন জলাবদ্ধতায় ভুগবে। তিনি আরও বলেন, ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও খালটির প্রস্থ অন্তত ৫০ ফুট ছিল, এখন কমতে কমতে মনে হয় ২০ ফুটে নেমেছে। মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডের ৫ নম্বর সড়কের অংশে খালের প্রস্থ ৫ থেকে ৭ ফুটের বেশি হবে না। অন্য অংশও আস্তে আস্তে দখল হয়ে যাচ্ছে।
খালের পাড়ে একটি টিনের বাড়িতে প্রায় ১৫ বছর ধরে থাকেন আমেনা বেগম। তিনি বলেন, খালে অন্তত চার ফুট মাটি জমেছে। এগুলো পরিষ্কার করে না ওয়াসা। ফলে বৃষ্টি হলে খাল উপচে মোহাম্মদী হাউজিংয়ের পাঁচ নম্বর ও তিন নম্বর সড়কের মাঝামাঝি অংশে পানি জমে থাকে। পানি ঢোকে তাঁর ঘরেও। তিনি বলেন, ‘খালের নোংরা পানি ঘরে ঢুকলে আমাদের কষ্টের আর সীমা থাকে না।’
রামচন্দ্রপুর খালের নবোদয় হাউজিং এলাকায় দেখা গেছে, নবোদয় কাঁচাবাজার-সংলগ্ন বস্তির পাশে গিয়ে খালটি একেবারে শুকনা। খালের মাঝখানে গজিয়েছে বড় বড় ঘাস। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা খালে এনে ফেলছেন বাজারের আবর্জনা।
খালের শেখেরটেক অংশটি আবার কিছুটা পরিষ্কার। কিন্তু শ্যামলী হাউজিংয়ের পেছনের অবস্থা এত খারাপ যে এখানে খালের এক পাশ থেকে অন্য পাশে মানুষ হেঁটে পার হন।
শ্যামলী হাউজিংয়ের বাসিন্দা মো. আবদুল্লাহ বলেন, দখলের পরও যতটুকু খাল টিকে ছিল, সেটুকু রক্ষা করা গেলেও এই এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকত না। খালটি মানুষের জীবিকার অংশ হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তাঁর কিছুই হচ্ছে না। মানুষ আবর্জনার পাশাপাশি পয়োনিষ্কাশন নালারও সংযোগ দিচ্ছে খালে। ওয়াসা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
রামচন্দ্রপুর খাল আদাবর ১৬ নম্বর গিয়ে কল্যাণপুর খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই সংযোগস্থলে খালটি আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, তবে অবস্থা মুমূর্ষু। এখানে খুব ধীরে এগিয়ে চলছে এর কালো-নোংরা পানি।
সম্প্রতি এ দুই খালের বিষয়ে কথা হয় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সঙ্গে। তিনি দাবি করলেন, খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু আশপাশের লোকজন আবর্জনা ফেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন খালগুলো স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে, যাতে তারাও দেখভাল করতে পারেন।
রামচন্দ্রপুর খাল শ্যামলী হাউজিংয়ের পেছনের অংশে ভরাট হয়ে যাওয়া এবং এর ওপর দিয়ে মানুষের হেঁটে চলাচল করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওয়াসার এমডি বিস্ময় জাগানিয়া তথ্য দিলেন। তাঁর দাবি, খালের এই অংশটি অনেক গভীর। ওপর থেকে ভরাট মনে হলেও অনেক নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।
জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই খাল দুটিকে বাঁচানো সম্ভব। আর চাইলে সব খালের সুরক্ষাই নিশ্চিত করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন সুশাসন ও রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। হাতিরঝিল ও ৩০০ ফুট সড়কের পাশে ১০০ ফুট করে খাল খনন এর বড় উদাহরণ।