'পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে বিমানবন্দরেই বেচে দেওয়া হয়'

‘কাতারের বিমানবন্দরে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে এক মালিকের কাছে বেচে দেওয়া হয়। ওই মালিক কোনো বেতন দেননি, বরং নির্যাতন করেছেন। সেখানকার পরিবেশ ছিল জেলখানার চেয়েও খারাপ। বাধ্য হয়ে পালিয়েছিলাম। পাসপোর্ট না থাকায় পুলিশের হাতে পড়তে হয়। জেলখানায়ও যেতে হয়। বিপদের সময় বাংলাদেশি দূতাবাসে সাহায্য চেয়েও পাওয়া যায় না।’

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহীতে অভিবাসন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে বিভাগীয় পরামর্শমূলক সভায় এভাবেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন কাতারফেরত এক নারী। ওই সভায় তিনিসহ চারজন বিদেশফেরত নিজেদের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা তুলে ধরেন।

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমান। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবুল বারকাত। বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

পরামর্শ সভায় বিদেশ থেকে ফিরে আসা রাজশাহীর দুজন নারী ও দুজন পুরুষ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। কাতারফেরত এক নারী বলেন, বিমানবন্দর থেকে এজেন্ট পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ৬ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে সেখানকার এক মালিকের কাছে তাঁকে বিক্রি করে দেন। মাস শেষে বেতন চাইতে গেলে ওই মালিক তাঁকে এ কথা জানিয়ে দেন। তাঁদের ভোর ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অমানুষিক কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। পাসপোর্ট না থাকায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে বাড়ি থেকে বিমানভাড়া পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে আনা হয়। তাঁর মতো অনেক মেয়ে কাতারের জেলখানায় পড়ে রয়েছেন। ফিরে আসার টাকার জোগাড় করতে পারছেন না।

জর্ডানফেরত এক নারী বলেন, তাঁর ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। তাঁর মা ঋণ করে টাকা জোগাড় করেছিলেন। সেই ঋণ এখনো শোধ হয়নি।

ব্রুনেইফেরত দুই যুবক বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সেখানে কোনো কাজ না দিয়ে তাঁদের ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য মানুষের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছেন। যে দালালের মাধ্যমে তাঁরা গিয়েছিলেন, তিনি এখনো বিদেশে রয়েছেন। তাঁর নামে মামলা করেছেন, কিন্তু টাকা আদায় করতে পারছেন না। তাঁরা ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছিলেন। কাজের জন্য তাঁরা আর কোনো দেশে যেতে চান না।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, অভিবাসী কর্মীদের শোভন পেশায় নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগসংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো আরও সজাগ হলে শ্রমিক নির্যাতন ও হয়রানি কমে আসবে। এতে তাঁরা আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে আরও বেগবান করবে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময়েও বাংলাদেশে নিরাপদ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন নীতিমালা হয়নি।

আবুল বারকাত উল্লেখ করেন, গত চার দশকে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ১২৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের ১৯০টি দেশে বর্তমানে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যাঁরা অবৈধ পথে গেছেন, তাঁদের অর্থ এর সঙ্গে যোগ হলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বেশি হবে। অভিবাসন সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সেগুলো সমাধানের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানান তিনি।

হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘ন্যূনতম সম্মানবোধ থাকলে দেশের নারীদের শ্রম বিক্রি করার জন্য আমরা বিদেশে পাঠাতাম না। আমরা কি পারব, কোনো দেশ থেকে একজন গৃহকর্মী কিনে আনতে? বিদেশিরা আমাদের দেশে আসেন বড় সেতু বানিয়ে দিতে। তাঁরা অভিবাসী হতে আসেন না।’