কলমের জায়গায় মুঠোফোন

২০১৫ সাল। আমি তখন রাশিয়ার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করতাম। আমার গবেষণার একটা বড় অংশ ছিল শতাব্দীর পালাবদলে সাংবাদিকতার পরিবর্তন। বিশেষভাবে নিউ মিডিয়া আর ডিজিটাল জার্নালিজম প্রথাগত সাংবাদিকতায় যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা কেমন হতে পারে, তাই ছিল আমার গবেষণার মূল আগ্রহ। সাংবাদিকতায় কীভাবে মোবাইল প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে রাশিয়ায় গবেষণা করি। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিউ মিডিয়া নিয়ে রাশিয়া ও ইউরোপে অনুষ্ঠিত অন্তত ১৫টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিই। 

মোবাইল ফোন দিয়ে যে পুরোদমে সাংবাদিকতা করা যায় তা ডাবলিনের সম্মেলনে হাতে-কলমে শেখানো হয়। একজন সাংবাদিক, যিনি স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসি ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রচারের কাজ করেন, তাঁকেই ‘মোবাইল সাংবাদিক’ বলা হয়। আর এটাকে সংক্ষেপে বলা হয় মোজো।

মস্কো থাকতেই প্রথম আলোতে মোবাইল সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও দেশীয় গণমাধ্যমে মোবাইল প্রযুক্তি শিরোনামে আমার লেখা দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদক মতিউর রহমান ২০১৬ সালে যখন সপ্তাহ খানেকের জন্য মস্কো বেড়াতে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমাদের কথা হয় নিউ মিডিয়া, মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে। তিনি আমাকে জুলাই মাসে প্রথম আলোর ঢাকা অফিসের সংবাদকর্মীদের জন্য মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে দুই দিনের কর্মশালা করার আমন্ত্রণ জানান। 

প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০১৬ সালের ২৬ থেকে ২৮ জুলাই ঢাকায় মোবাইল সাংবাদিকতা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন ৩ ঘণ্টাব্যাপী ওই কর্মশালায় সাংবাদিকদের ‘তাত্ত্বিক’ ও ‘ব্যবহারিক’—এই দুটি অংশে প্রশিক্ষণ দিই। কর্মশালায় ঢাকা অফিসের ৫০ জন সাংবাদিক অংশগ নেন। মোবাইল সাংবাদিকতা বা মোজো নিয়ে তাদের সবার মাঝে অনেক আগ্রহ দেখা যায়।

সেই থেকেই প্রথম আলোয় আনুষ্ঠানিকভাবে মোবাইল সাংবাদিকতার চর্চাটা শুরু হলো। ওই প্রশিক্ষণগুলোতে অংশ নেওয়া সাংবাদিকেরা এখন নিয়মিতভাবে মোবাইল দিয়ে সংবাদ লিখছেন, ভিডিও রেকর্ড ও সম্পাদনা করছেন, আবার মোবাইল দিয়েই তা বার্তাকক্ষে পাঠাচ্ছেন। 

মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের আরও একটি কর্মশালার জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে আবার মস্কো থেকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। এবার ভিডিওটি কীভাবে আরও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যায় এবং কী করে অল্প সময়ে তা বার্তাকক্ষে পাঠানো যায়, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। 

সাংবাদিকতা নিয়ে পিএইচডি শেষ করে এ বছরের জুলাইয়ে দেশে ফিরে আসি। ১ আগস্ট থেকে মোবাইল সাংবাদিকতা বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রথম আলোতে যোগদান করি। ২১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী ১ মাস দেশের চারটি অঞ্চলে প্রথম আলোর প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমাকেও ওই সময় মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে কর্মশালা করতে বলা হয়। আমাদের দলটিকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে। পুরো এক মাস আমরা বগুড়া, খুলনা, সিলেট আর চট্টগ্রাম ঘুরে বেরিয়েছি। প্রতিটি ভেন্যুতে আমার কর্মশালায় সবার উপস্থিতি ও উৎসাহ আমাকে আশাবাদী করেছে। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে এখন আমাদের ১৮৪ জন কর্মী মোবাইল দিয়ে সাংবাদিকতা চর্চা করার দক্ষতা অর্জন করেছেন। কর্মশালা শেষে নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে অনেকেই নিয়মিত খবরের সঙ্গে ভিডিও পাঠাচ্ছেন। 

২৫ অক্টোবর কক্সবাজারে প্রথম আলোর প্রতিনিধি সম্মেলনে মোবাইল সাংবাদিকতা চর্চায় সারা দেশের ছয়জন সাংবাদিককে সম্পাদক মতিউর রহমানের উপস্থিতিতে সম্মানিত করা হয়।

ভোলার প্রথম আলো প্রতিনিধি নেয়ামত উল্লাহ ছিলেন ওই ছয়জনের একজন। কিছুদিন আগেও ঢাকা অফিসে খবর পাঠানোর জন্য সদর অফিসে তাঁকে আসতে হতো, কিন্তু এখন তিনি নৌকায় বসে, ধানখেত থেকে কিংবা চলতি পথে হাঁটতে হাঁটতে খবর টাইপ করে আর তার সঙ্গে ভিডিও যুক্ত করে আমাদের পাঠাতে পারছেন। সাংবাদিকতার কাজে মোবাইল ফোনের এই কৌশল অবলম্বনের জন্য মোবাইল সাংবাদিকতাকে আমি ‘জার্নালিজম অন দ্য গো’ বলি।

প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা মোবাইল ফোন দিয়েই অনেক বড় ধরনের ঘটনার খবর সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হোলি আর্টিজান হামলা, ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কীর্তনখোলা নদীভাঙন, তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ধস, রোহিঙ্গা সংকট, নোবেল পুরস্কার বিতরণ, মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ফিফা কনফেডারেশনস কাপ প্রভৃতি।

প্রথম আলোতে মোবাইল সাংবাদিকতা চর্চার খবর নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত সাংবাদিকতা–বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল ‘জার্নালিজম ডট সিও ডট ইউকে’ এ পর্যন্ত দুবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এই লেখাটি মোবাইল দিয়ে যখন লিখছি, তখন আমি রাঙামাটিতে। গত ১৩ জুন পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এখন কেমন আছেন তা জানতে ২৮ অক্টোবর কক্সবাজার থেকে এখানে আসি। খবর সংগ্রহ করতে শুধু আইফোন আর একটি ইন্টারভিউ মাইক্রোফোন সঙ্গে এনেছি।