শুদ্ধ সংগীতের বৃহৎ আয়োজন

বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা, ২০১৬। ছবি: প্রথম আলো
বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা, ২০১৬। ছবি: প্রথম আলো

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্ভবত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’। উৎসবটি শুধু আকারে বা কলেবরে বড় নয়, বড় ব্যবস্থাপনায়, লক্ষ্য অর্জনে এবং সুরের মায়ায় ছুটে আসা হাজার হাজার মানুষের সম্মিলন ঘটানোয়।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় সব মধ্যবিত্ত পরিবারই ছেলেমেয়েদের গানের স্কুলে পাঠানো, ছবি আঁকার স্কুলে পাঠানোতে উৎসাহী থাকতেন। ছায়ানট ও বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) কিছুকাল গান-নাচ শেখেনি এমন ছেলেমেয়ে ঢাকায় খুব কমই ছিল। জেলা শহরগুলোতেও এমন অনেক গুণী মানুষ ছিলেন, যাঁরা নিজের সব কাজ ফেলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়েদের সংগীতশিক্ষা দিতেন। যেমন চট্টগ্রামের মিহির নন্দী, সিলেটের রামকানাই দাশ এমন অনেকের ঋণ অপরিসীম।
পরবর্তী সময়ে দেখেছি শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে প্রতিভাবান ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করতেন, তাদের অন্তরে বাংলা সংগীতের বীজ রোপণ করার কাজে তিনি সারা জীবন নিয়োজিত ছিলেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, উচ্চাঙ্গসংগীতে আমরা উপমহাদেশে প্রতিনিধিত্ব করার মতো শিল্পী স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে তৈরি হতে দেখিনি। যদিও এ দেশেই জন্মেছেন উপমহাদেশের শুদ্ধ সংগীতের জনক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উদয় শংকর, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, ইমদাদ হোসেন খান ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ সংগীতকার। কিন্তু এ দেশের মানুষের শুদ্ধ সংগীতের প্রতি যে টান ও ভালোবাসা অটুট ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে ২০১২ সালে বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের মধ্য দিয়ে।
২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব এ উপমহাদেশের সব আয়োজনকে ম্লান করে দিল। হঠাৎই শুনলাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশন উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান হবে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। চার রাত। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে শ্রোতারা গান শুনতে পারবেন। আমি ভাবলাম এ কীভাবে সম্ভব! খোলা মাঠে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে কে যাবে! এবং হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, শিবকুমার শর্মা, রশিদ খান, অজয় চক্রবর্তী, বিরজু মহারাজ—এঁদের মতো শিল্পীদের পরিবেশনা বিনা মূল্যে কেনই বা শোনাবে! কিন্তু অভিজ্ঞতা হলো ভিন্ন। ২০১২ ও ২০১৩ সালে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, হরতাল উপেক্ষা করে ২৫-৩০ হাজার মানুষ সারারাত স্টেডিয়ামে বসে সুরের ভুবনে ডুবে ছিলেন। অংশগ্রহণকারী শিল্পী থেকে শ্রোতা, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে বলতে শুনেছি, এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা। শুদ্ধ সংগীত যে এক মায়াবিস্তারী, এতটা নিমগ্নতা, এ উৎসবে না গেলে বুঝতে পারতেন না শ্রোতারা। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে উৎসব করা হলো পাঁচ রাত। আর্মি স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ পরিণত হলো জনসমুদ্রে। ৫০ থেকে ৫৫ হাজার মানুষ জড়ো হতে লাগলেন প্রতি রাতে। এটি হয়ে উঠল বিশ্বের সর্ববৃহৎ উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর। যিনি কখনোই শুদ্ধ সংগীত শুনতেন না তিনিও এক রাত এসে যেন দেখে যেতে চাইলেন কী ঘটছে এখানে। কিসের আকর্ষণে এত মানুষ আসছেন! আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নভেম্বর এলেই মানুষ হন্যে হয়ে খোঁজ নিতে থাকেন কীভাবে বেঙ্গল উৎসবের আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করা যায়। এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এ পাঁচটি দিন লক্ষ করে বহু মানুষ পাঁচ বছর ধরে দেশে আসছেন ভালো গান শোনার প্রত্যাশা নিয়ে। দেখেছি আট-দশটা বাসভর্তি ছেলেমেয়ে (তরুণ) পিলপিল করে উৎসবস্থলে প্রবেশ করতেন সারা রাত থাকার জন্য। নানা বয়সের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ, বিশ্বের নানা ভাষাভাষীর মানুষ, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজারো মানুষ যেন ছুটে এসেছেন এই মিলনভূমিতে।
আমার ধারণায় এটা প্রাণের উৎসবে পরিণত হওয়ার একটা বড় কারণ, এতগুলো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীর পরিবেশনা বিনা মূল্যে সামনে থেকে শোনার সুযোগ ও বেঙ্গলের ত্রুটিহীন ব্যবস্থাপনা। খাওয়াদাওয়া, সংগীত ও আনন্দের খোরাক, প্রাণের আরাম, মনের প্রশান্তি সবটাই মিলছিল এ উৎসবে।
আমি সংগীতের মানুষ। তারপরও এমন বিরল কিছু শিল্পীর পরিবেশনা শোনার ও দেখার সুযোগ হয়েছে এই পাঁচ বছরে, যা হয়তো সারা জীবনেও সম্ভব হতো না। গুন্ডেচা ব্রাদার্সের ধ্রুপদ, দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত, ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা, বাহাউদ্দীন ডাগরের মোহন বীণা, আমজাদ আলী খানের সরোদ—এ উৎসব ছাড়া কারোরই খুব সহজে শোনার সুযোগ ছিল না। আরও বড় যে লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছে, তা হলো তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করা গেছে। তারা বেঙ্গল পরম্পরায় শিখতে আগ্রহী হচ্ছে, চর্চা করছে, বিশ্বের দু–এক জায়গায় গাইবার ডাকও ইতিমধ্যেই পাচ্ছে। আরও অনেক ছেলেমেয়েকে এই সংস্কৃতিচর্চায়, বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় যুক্ত করা প্রয়োজন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আরও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। এমন সুস্থ সংগীতের স্রোতে যেন তরুণসমাজের জঙ্গিবাদী চিন্তা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নির্বুদ্ধিতা সব ভেসে যায়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যেসব শিল্পী এ উৎসবে অংশ নিয়েছেন তাঁদের পাশাপাশি এক মঞ্চে এ দেশের শিল্পীরাও জায়গা করে নিয়েছেন। খুব গর্ববোধ করি যখন তাঁরা সবাই প্রতিবছরই বলতেন, এমন শ্রোতা, এমন ব্যবস্থাপনা তাঁরা বিশ্বের কোথাও দেখেননি। সে বিচারে এ আয়োজন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শুদ্ধ সংগীতের আয়োজন।

অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের কয়েকজন

১. পণ্ডিত বিরজু মহারাজ
২. পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া
৩. বিদুষী গিরিজা দেবী
৪. বিদুষী কিশোরী আমনকার
৫. পণ্ডিত বালমুরালি কৃষ্ণ
৬. পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
৭. পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা
৮. ওস্তাদ জাকির হোসেন
৯. ওস্তাদ রইস খান
১০. ওস্তাদ রশিদ খান
১১. পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
১২. পণ্ডিত এল সুব্রামানিয়াম
১৩. ওস্তাদ আশীষ খান
১৪. বেগম পারভীন সুলতানা
১৫. ওস্তাদ আমজাদ আলী খান
১৬. পণ্ডিত উলহাস কাশালকার
১৭. ওস্তাদ সুজাত হোসেন খান
১৮. পণ্ডিত কুমার বোস
১৯. পণ্ডিত রাজন ও সাজন মিশ্র
২০. পণ্ডিত কড়াইকুড়ি মানি
২১. পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
২২. বিদুষী বম্বে জয়শ্রী
২৩. বিদুষী অরুণা সাইরাম
২৪. বিদুষী অশ্বিনী ভিড়ে দেশপাণ্ডে
২৫. বিদুষী শুভা মুদগাল
২৬. পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার
২৭. পণ্ডিত কুশল দাস
২৮. বিদুষী মাধবী মুদগাল
২৯. পণ্ডিত রনু মজুমদার
৩০. বিদুষী আলারমেল ভাল্লি
৩১. ড. এন রাজম
৩২. ড. প্রভা আত্রে
৩৩. ওস্তাদ ওয়াসিফউদ্দিন ডাগর
৩৪. ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান
৩৫. বিদুষী শুভ্রা গুহ
৩৬. বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকার
৩৭. বিদুষী মালবিকা সারুক্কাই
৩৮. পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার
৩৯. কৌশিকী চক্রবর্তী
৪০. পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়
৪১. রাহুল শর্মা
৪২. আমান ও আয়ান আলী বাঙ্গাশ

অদিতি মহসিন: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী।