বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

ঢাকার রাজপথে নূর হোসেন। ছবি: পাভেল রহমান
ঢাকার রাজপথে নূর হোসেন। ছবি: পাভেল রহমান

জাওয়াদ হোসেন তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুলের পাঠ্যবইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। একসময় চমকে ওঠে ছেলেটি। ভয়ংকর বা রোমাঞ্চকর কোনো গল্প পড়ে নয়। একটি নিরেট, সাদামাটা ইতিহাস কিশোরের রক্তে কম্পন জাগায়। ইতিহাসের এই অংশে তার রক্তের পূর্বসূরির বর্ণনা। বইয়ে তাঁর ছবি, যাকে সে কোনো দিন চোখে দেখেনি। দেখেছে পত্রিকায়, টিভিতে। অজস্র মানুষের মিছিলে তাঁর নামে স্লোগান শুনেছে অনেকবার। প্রতিবছর ১০ নভেম্বর এলে জাওয়াদের অদেখা অথচ খুব পরিচিত মানুষটির তামাটে বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা ছবিটি শোভা পায় অনেক জায়গায়। 

শুধু বাইরে তাঁর ছবি দেখে নয়, বাড়িতে সেই ছোট্টবেলা থেকে অবিশ্বাস্য সব সাহসের কথা শুনেছে মানুষটিকে নিয়ে। আর তাই ওর কাছে হয়ে উঠেছে রূপকথার নায়ক। সেই নিজস্ব-নায়ককে বইয়ের পাতায় দেখে বিস্ময় জাগে কিশোরের মনে। মানুষটি জাওয়াদের চাচা শহীদ নূর হোসেন।
১৯৮৭-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর বনগ্রামের একঘরের বাড়িতে থাকা দরিদ্র পরিবারের এই শ্রমিক-যুবক দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। নির্মম বুলেট তাঁর বুক বিদীর্ণ করে। বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখেছিলেন নূর হোসেন। এক অখ্যাত, অজ্ঞাত যুবকটির এই সাহসী এবং অভিনব প্রতিবাদ সারা দেশের মানুষকে করেছিল অভিভূত। ওই ঘটনার পর ৩০ বছর চলে গেছে। সেই ইতিহাস এখন এখনকার কিশোরদের পাঠ্য। জাওয়াদ নূর হোসেনের ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে গিয়ে কথা হয় নূর হোসেনের মা, তাঁর দুই ভাই, বোন, ভাতিজা-ভাতিজিদের সঙ্গে। জাওয়াদ বলে, ‘ক্লাসে যখন চাচার (নূর হোসেন) সেই কাহিনি পড়াত, আমার বুক ভরে যেত। আমি কোনো দিন নিজের পরিচয় দিইনি। শুধু এই ভেবে গর্ব হতো, আমার চাচা দেশের জন্য কী অসম্ভব কাজ করে গেছেন। আর আমার চাচা আমার পড়ার বিষয়। শুধু আমার নয়, দেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে তাঁর কথা পড়ছে।’

৩০ বছর পরও মা মরিয়ম বেগমের স্মৃতিতে অমলিন ছেলে শহীদ নূর হোসেন। দারুস সালাম, ঢাকা, ৭ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
৩০ বছর পরও মা মরিয়ম বেগমের স্মৃতিতে অমলিন ছেলে শহীদ নূর হোসেন। দারুস সালাম, ঢাকা, ৭ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

বনগ্রামে ট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমান ও গৃহিণী মরিয়ম বেগমের ছয় সন্তানের একজন নূর হোসেন। দরিদ্র পরিবারে এতগুলো ভাইবোন এক জায়গায় থাকা বড় অসুবিধা ছিল। পরিবারের মেজ ছেলে, আরেক পরিবহনশ্রমিক নূর হোসেন তাই থাকতেন মতিঝিলের ডিআইটি বিল্ডিংয়ের পাশের মসজিদের একটি ছোট ঘরে। তখন ২৪-এর টগবগে যুবক তিনি। লেখাপড়া খুব বেশি করেননি। তবে মা মরিয়ম বললেন, ‘ছেলে নিজে নিজে লেখাপড়া করত। ডায়েরি লিখত।’
ছেলেটির স্মৃতি আওড়ান সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা। তাঁর সঙ্গে কথা হয় মাজার রোডে তাঁর ছেলের বাড়িতে। জানান, আজন্ম কষ্টে থাকা পরিবারকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা বরাবরই বলতেন নূর। মরিয়ম বলেন, ‘একদিন কিছু কইর‍্যা দ্যাখানোর কথা বলত প্রায়ই। আমাগো গরিব পরিবারে একেবারে অন্য রকম ছিল।’
কেমন ছিলেন সেই অন্য রকম? ভাই দেলোয়ার বললেন, ‘ভোরবেলা উইঠ্যা ব্যায়াম করতেন ভাই। শরীরের জন্য খারাপ কোনো কিছু খাইতে দেখি নাই। চোখের সামনে অন্যায় কিছু দেখলেই ঝাঁপাইয়া পড়তেন। মনে হয় তাঁর জন্মই হইছিল প্রতিবাদের জন্য।’
বাড়ির বড় ছেলে, নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন ভাইয়ের এই বেশি বেশি সাহসে বড় ভয় পেতেন। ১০ নভেম্বর ছিল সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি। আলী হোসেন বললেন, ‘খুব বড় গন্ডগোল হবে এটা বুঝতে পারছিলাম। ও যাতে মিছিলে বা রাস্তায় না যায়, সে জন্য ওকে বারণও করছি।’
পরিবারের এই ‘অন্য রকম’ ছেলের সম্ভাব্য বিপদ কী নিকটজনদের অন্তরাত্মা শুনিয়েছিল? হয়তো বা। আর সে জন্যই মা-বাবা মিলে ডিআইটিতে ১০ নভেম্বর ভোরে চলে যান নূর হোসেনের ডেরায়। মা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘ফজরের পরই চইল্যা গেলাম। এত সকালে আমাগো দেইখ্যা আশ্চর্য হয়।’ তাঁরা দেখেন, নূর হোসেনের বুকে ও পিঠে সাদা রঙের লেখা। তাঁদের দেখে দ্রুত গায়ে চাদর জড়ান। মা-বাবা ছেলেকে সাবধান করতে যান, যেন আজ মিছিলে বের না হয়। ছেলে প্রতিশ্রুতি দেয়। মায়ের কাছে সে কথা এখনো মনে আছে। নূর হোসেন বলেছিলেন, ‘আপনারা যান। আমি আসতেছি।’ এরপর ভাইবোনের জন্য ফল কিনে দেন। নূর হোসেন আর কোনো দিন যাননি বাড়ি। তাঁর লাশও পরিবার পায়নি।
নূর হোসেনের বুকে-পিঠের সেই লেখারও একটি ইতিহাস আছে।
মো. ইকরাম হোসেন ওই লেখা লিখেছিলেন। সেই সময় মতিঝিলের বিসিআইসি ভবনের পাশে ব্যানার ও সাইনবোর্ড আঁকতেন ইকরাম। নূর হোসেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। এখনো সেই স্লোগান লেখার কথা মনে আছে ইকরামের। ১৯৮৭-এর ৭ নভেম্বর নূর হোসেন তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘ইকরাম ভাই, আপনার অ্যাকটা কাজ কইর‍্যা দেওয়া লাগব।’ কী কাজ, এর কোনো উত্তর দেননি নূর হোসেন। শুধু বলেছিলেন, ‘এমন কাজ করবেন, যা কোনো দিন করেন নাই।’ এরপর ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার নূর হোসেন ইকরামের কাছে এসে সাদা রং নিয়ে তাঁর সঙ্গে যেতে বলেন। পাশের একটি বস্তিতে গিয়ে জামাটি খুলে ফেললেন। এভাবে জামা খুলতে দেখে বিস্মিত হন ইকরাম। নূর হোসেন এবার বললেন, ‘আমার বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক, পিঠে লেখেন গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ এ কথা শুনে স্তব্ধ শিল্পী ইকরাম। নূর হোসেনকে বোঝাতে থাকেন, এ কাজের অর্থ হলো নিশ্চিত কারাগারে যাওয়া। সেই সঙ্গে তাঁর নিজেরও বিপদে পড়া। তিনি এ কাজ করতে সোজাসাপ্টা না করে দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা নূর হোসেন। ইকরাম বলছিলেন, ‘আমি দ্যাখলাম সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আর আমি জেলে যাইতেছি।’

শহীদ নূর হোসেনের একটি দুর্লভ আলোকচিত্র। ছবি: আলী হোসেনের সৌজন্যে
শহীদ নূর হোসেনের একটি দুর্লভ আলোকচিত্র। ছবি: আলী হোসেনের সৌজন্যে

ইকরাম ১০ নভেম্বরের পর তিন বছর পালিয়ে ছিলেন। তাঁকে জেলে যেতে হয়নি। তবে নূর হোসেনকে নিয়ে যে ভাবনা তাঁর ছিল, তা বাস্তবে ফলেছে।
১০ নভেম্বর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তপ্ত হয় ঢাকা। এরশাদের পতনের দাবিতে রাজপথ সরগরম। আর নূর হোসেন তখন মিছিলের নেতৃত্বে। বড় ভাই আলী হোসেন সকাল ১০টার দিকে দেখেন নূর হোসেন মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভাইকে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি মিছিলের দিকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা, ‘ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি নাই। যেন আগুন জ্বলতেছে।’
সচিবালয়ের পাশে, জিপিওর মোড়ে নূর হোসেন নামের অগ্নিকুণ্ড স্তিমিত হলো বুলেটের ঘায়ে। কবি শামসুর রাহমান যেমনটি লিখেছেন তাঁর কবিতায়, ‘ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়’।
নূর হোসেনের মৃত্যুর খবর দুপুরের দিকেই পরিবার পায়। তারপর দিগ্‌বিদিক তারা খোঁজ শুরু করে। বিভিন্ন হাসপাতাল, আঞ্জুমান মফিদুল কোথাও পাওয়া যায়নি। নূর হোসেনের বোন শাহানা বললেন, ‘সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম, ভাই নেই।’
পরে শাহবাগে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যায় নূর হোসেনের পরিবার। পুলিশের এক কর্মকর্তা এই বলে নূর হোসেনের বাবাকে ফিরিয়ে দেন যে একটি ছেলের লাশ থেকে আরও অনেক ছেলে লাশ হতে পারে। পরে জুরাইন কবরস্থানে নূর হোসেনের লাশ কবর দেওয়ার কথা জানতে পারেন তাঁরা। কবর খোদকেরা জানান, একটি লাশের বুকে-পিঠে লেখা ছিল। কেরোসিন দিয়ে তারা তা তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। ওঠেনি। সেই লেখার জন্যই লাশটিকে শেষতক চিহ্নিত করা যায়। বুকে লেপটে যাওয়া বর্ণমালা নিয়ে মাটিতে শায়িত হন নূর হোসেন। বুক যার ‘বাংলাদেশের হৃদয়।’