টাকার জন্য বন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিপণ দাবি ৩ কিশোরের

জাহিদ হাছান
জাহিদ হাছান

নবম শ্রেণির এক ছাত্রকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তারই তিন কিশোর বন্ধু। পরে পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল তারা। মুঠোফোনের সূত্র ধরে ওই তিন কিশোরকে পুলিশ আটকের পর বেরিয়ে আসে বন্ধুকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ বিদ্যালয়ের সেপটিক ট্যাংকে রাখার লোমহর্ষক তথ্য। পুলিশ বলেছে, মুক্তিপণ হিসেবে টাকা জোগাড়ের জন্য ওই তিন কিশোর ভয়ংকর এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির সর্বশেষ এ ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লার হোমনা উপজেলায়। এর শিকার হয়েছে জাহিদ হাছান (১৪)। বন্ধু ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ এই কিশোরের লাশ দুই দিন পর গত বুধবার রাত ১০টার দিকে পুলিশ উদ্ধার করেছে তারই বিদ্যালয়ের সেপটিক ট্যাংক থেকে।
এর আগে রাজধানীর উত্তরা, শেওড়াপাড়া, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোরদের হাতে তাদের বন্ধু বা অন্য কিশোর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত মার্চে শেওড়াপাড়ায় বন্ধুদের আড্ডায় কথা-কাটাকাটির জেরে খুন হয় সজীব মিয়া (১৪)। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে কামরাঙ্গীরচরে দুই বন্ধুর হাতে খুন হয় আলিফ। আর অক্টোবরে হাজারীবাগে এক কিশোরের হাতে খুন হয় কিশোর এরফান (১৫)।
হোমনা উপজেলার দুলালপুর চন্দ্রমণি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদ নিখোঁজ হয়েছিল গত সোমবার সন্ধ্যায়। হোমনা থানা-পুলিশ ও জাহিদের পরিবারের সূত্র বলেছে, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে উপজেলার সাফলেজি গ্রামের বাড়ি থেকে জাহিদকে এক বন্ধু ডেকে নিয়ে যায়। তারপর থেকে জাহিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার জাহিদের বাবা কাপড় ব্যবসায়ী মো. আক্তারুজ্জামান এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। মঙ্গলবারই একটি মুঠোফোন থেকে জাহিদের চাচা মাসুদ রানার মুঠোফোনে ফোন করে ও খুদে বার্তা দিয়ে জাহিদের মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বুধবার মুঠোফোনের সূত্র ধরে জাহিদের তিন বন্ধুকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এদের দুজন একটি বিদ্যালয়ের এবং অপরজন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা জাহিদকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ওই বিদ্যালয়ের সেপটিক ট্যাংকে রাখার কথা স্বীকার করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বুধবার রাত ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে পাঠানো হয়।
জাহিদের চাচা দুলালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, ‘আমার মুঠোফোনে মঙ্গলবার একটি নম্বর থেকে ফোন করে ভাতিজার মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে একাধিক মুঠোফোন থেকে খুদে বার্তা পাঠিয়েও মুক্তিপণ চাওয়া হয়।’
হত্যার ঘটনায় জাহিদের বাবা ওই তিন কিশোরকে আসামি করে বুধবার রাতেই থানায় মামলা করেছেন। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দুজনের বাড়ি একই উপজেলার ভিটি কালমিনা গ্রামে। অপরজনের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলার মটকির গ্রামে। পুলিশ বলেছে, ওই তিন কিশোর বলেছে, তাদের কাছে টাকা ছিল না। তাই টাকা জোগাড়ের জন্য তারা বন্ধু জাহিদকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে। ওই রাতেই তাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ সেপটিক ট্যাংকে রেখে দেয়। পরদিন মুক্তিপণ দাবি করে।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে জাহিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলে জাহিদের ছবি বুকে নিয়ে মা জ্যোৎস্না বেগম বিলাপ করছেন। তাঁর বোনসহ আরও অনেকে কাঁদছেন। বাড়িতে আসা এলাকাবাসীর চোখেও পানি। জ্যোৎস্না বেগম বারবার বলছিলেন, ‘আমার জাহিদকে ফিরাইয়া দাও।’
জাহিদের বাবা বলেন, ‘আমার পোলারে টাকার জন্য তিন বন্ধু মিলে মাইরা ফালাইছে। আমার একমাত্র ছেলে, ও আমার স্বপ্ন ছিল। ঘাতকেরা জাহিদকে হত্যা করে আমার স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’
দুলালপুর চন্দ্রমণি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরিফুল ইসলাম বলেন, জাহিদ মেধাবী ও বিনয়ী ছাত্র ছিল। এই হত্যাকাণ্ড সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। জাহিদের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার দাবি করেন তিনি।
হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রসুল আহমদ নিজামী বলেন, ১৫ দিন আগেই জাহিদকে হত্যার পরিকল্পনা করে তার তিন বন্ধু। মুক্তিপণ দাবির মুঠোফোনের সূত্র ধরে ওই তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা শ্বাসরোধে জাহিদকে হত্যার কথা স্বীকার করে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে পরে লাশ উদ্ধার করা হয়। সহজে টাকা পেতে তারা এই পথ বেছে নেয় বলে জানিয়েছে।