বিএনপি ও যুবদল নেতাসহ 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত তিন

নোয়াখালী, ফেনী ও সিরাজগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিএনপি ও যুবদলের দুই নেতাসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা তিনজনই তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বলে পুলিশের দাবি। তবে বিএনপি ও যুবদলের দুই নেতার পরিবার বলছে, তাঁদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম (৪৫), ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়ন যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি গোলাম সরওয়ার (২৮) ও সিরাজগঞ্জের বাবলু মিয়া (৩২)।
এ নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা গুলিবিনিময়ের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ২০। তাঁদের মধ্যে ১৬ জনই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। এসব মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, বিচারবহির্ভূতভাবে কারও শাস্তি তাঁর প্রাপ্য হতে পারে না।
সোনাইমুড়ীতে বিএনপির নেতা নিহত: সোনাইমুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সামাদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার
রাতে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে আটক করে র‌্যাব-৩। পরে পুলিশের কাছে তাঁকে হস্তান্তর করা হয়।
সোনাইমুড়ী থানার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তৌহিদুল তাঁর কাছে অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেন। সেই অস্ত্র উদ্ধারে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তৌহিদুলকে নিয়ে পুলিশের একটি দল তাঁর গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালায়। বাড়ির রান্নাঘরের টিনের নিচ থেকে একটি এলজি ও তিনটি গুলি উদ্ধার করা হয়। এ সময় বাড়ির গৃহকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে পরিবারের অন্য কেউ ঘর থেকে বের হননি।
পরে অস্ত্রসহ তৌহিদুলকে থানায় নিয়ে আসার পথে গ্রামের মেহেদীপাড়ায় বিএনপির কর্মীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। এতে তৌহিদুল গুলিবিদ্ধ হন। তাৎক্ষণিক পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
তৌহিদুল উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়নের ভদ্রগাঁও গ্রামের মৃত নুর আহম্মদ মাস্টারের ছেলে।
নিহত তৌহিদুলের ছোট ভাই কামাল হোসেন দাবি করেন, মেহেদীপাড়ায় কোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ পরিকল্পিতভাবে তাঁর ভাইকে হত্যা করেছে।
স্থানীয় আমিশাপাড়া খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবুল হোসেন বলেন, ‘তৌহিদ আমার ছাত্র। বিএনপি করলেও সে সব দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। দুই দলের মারামারি হলে সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে তা থামানোর চেষ্টা করত। তৌহিদ কোনো অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসী ছিল না।’
এ ঘটনায় বিএনপির ক্ষুব্ধ কর্মীরা গতকাল সকালে আমিশাপাড়া বাজার সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেন। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আনিসুর রহমান দাবি করেন, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় কনক ও সামাদ নামের দুই কনস্টেবলও আহত হন।
সোনাইমুড়ী থানার ওসি জানান, তৌহিদুলের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলাসহ সাতটি মামলা রয়েছে। থানার তালিকাভুক্ত ৩ নম্বর সন্ত্রাসী তিনি।
ফেনীতে নিহত যুবদল নেতা: পুলিশ জানায়, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি এবং পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গোলাম সরওয়ারকে গ্রেপ্তারের জন্য গতকাল বিকেল চারটার দিকে ফেনী সদর উপজেলার উত্তর ফাজিলপুর গ্রামের লস্কর তালুকে অভিযান চালায় র‌্যাব ও পুলিশ। এতে নেতৃত্ব দেন র‌্যাবের ফেনী ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর মহিউদ্দিন।
পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গোলাম সরওয়ার তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। র‌্যাব-পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে গোলাম সরওয়ার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে একটি কাটা রাইফেল ও একটি দেশি এলজি উদ্ধার করা হয়।
ফেনীর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মো. সামছুল আলম সরকার জানান, গোলাম সরওয়ারের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ছাড়াও সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। তিনি পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।
উপজেলার উত্তর ফাজিলপুর গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে গোলাম সরওয়ার।
সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, নিহত গোলাম সরওয়ারের বড় ভাই ফাজিলপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. সাহজাহান তাঁকে জানিয়েছেন, র‌্যাব তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে।
সিরাজগঞ্জে নিহত ১: র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত বাবলু মিয়া সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের বাঐতারা গ্রামের আবদুল ওয়াহাবের ছেলে।
র‌্যাব-১২ সিরাজগঞ্জের কোম্পানি অধিনায়ক সহকারী পুলিশ সুপার অশোক পালের ভাষ্যমতে, নাশকতার উদ্দেশ্যে কিছু সন্ত্রাসী অস্ত্রসহ সিরাজগঞ্জ শহরের কাটাওয়াপদার চায়না হারবারের বালুর বাঁধ এলাকায় সংগঠিত হয়েছে—এমন সংবাদ পেয়ে র‌্যাবের একটি দল বুধবার দিবাগত রাত সোয়া দুইটার দিকে সেখানে অভিযান চালায়। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ১৫ মিনিট গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে বাবলু নামের এক সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। অন্যরা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে একটি রিভলবার, একটি শটগান ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
সদর থানার ওসি হাবিবুল ইসলাম জানান, বাবলুর বিরুদ্ধে থানায় তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলারও একজন এজাহারভুক্ত আসামি তিনি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সরবরাহ করেছেন প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ ও ফেনীর নিজস্ব প্রতিবেদক এবং নোয়াখালী অফিস]