ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পরিবারগুলো

এখন অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান রীতা হালদার। স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা তাঁর মাথায়। স্বামী অজিত হালদারই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ঘূর্ণিঝড় সিডর তাঁকে কেড়ে নেয়। ছোট দুই ছেলেকে (বয়স ১২ ও ১০ বছর) নিয়ে বিপদে পড়েন রীতা।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মালোপাড়ার বাসিন্দা অজিত হালদার মাছ ধরতে সাগরে গিয়েছিলেন। সেই রাতের ঘূর্ণিঝড়ে তালা উপজেলার ছয় জেলেসহ জেলার ১১ জন প্রাণ হারান। তাঁদের পরিবারগুলো এখনো সিডরের ক্ষত সারিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

সিডরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদরের মালোপাড়ার গৌর হালদার (৪৮), অজিত হালদার (৪৩), সুজিত হালদার (৫২), বাউখোলা গ্রামের গোবিন্দ বিশ্বাস (৫৮), জাতপুর গ্রামের নূর বেগম (৬০) ও টিকারামপুর গ্রামের হাসান গাজী (৫০), শ্যামনগর সদরের গাবুরা গ্রামের ফজিলা বিবি (৪), ছেলে সুমন (১০) ও মেয়ে রাশিদা (৬), আশাশুনি উপজেলার একসরা গ্রামের আব্দুল্যাহ (১৫) ও আয়শার (১০) মৃত্যু হয়।

আবার সাগরে

অনেকের পরিবারেরই এখন চরম দুর্দিন যাচ্ছে। কারণ, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন তিনিই। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত ছিলেন। সেই বোঝা চেপেছে পরিবারের ঘাড়ে। এলাকায় অন্য কোনো কাজ না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই পরিবারের সদস্যরা সমুদ্রে যাচ্ছেন মাছ ধরতে।

গৌর হালদারের স্ত্রী আরতি হালদার বলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপর স্বামীর নেওয়া ধারের প্রায় পাঁচ লাখ টাকা শোধ করতে পারেননি এখনো। তাঁর দুই ছেলে উত্তম হালদার ও মিন্টু হালদার জীবিকার তাগিদে এখন সাগরে যাচ্ছে মাছ ধরতে। সিডরের পর কিছু সহায়তা পেলেও বর্তমানে তাঁদের খোঁজ রাখে না কেউ।

ছেলে উত্তম হালদার ১৫ নভেম্বরের রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। দুর্গাপূজার দশমীর পরের দিন তাঁরা মাছ ধরতে সাগরে যান। সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় মাছ ধরতে ব্যস্ত সবাই। মাছ পড়ছে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। সবাই বেশ উৎফুল্ল। হঠাৎ সংবাদ আসে, বড় আসছে। সাগরে তুফান বইবে। তখন দুপুর গড়িয়েছে সবে। ব্যস্ততা বাড়ে সবার। সন্ধ্যার আগেই হঠাৎ অন্ধকার নামে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে হালকা বাতাস। ট্রলারের গতি বাড়িয়ে শুরু হয় নিরাপদ স্থানে ফেরার নিরন্তর চেষ্টা। কিন্তু শোঁ শোঁ শব্দে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। সেই সঙ্গে ১৫-২০ ফুট উচ্চতার ঢেউ। ট্রলার উল্টে যায়। সবাই পাশের একটি ট্রলারে ওঠার চেষ্টা করেন। উত্তম পারলেও পারেননি বাবা গৌর আর ছোট ভাই মিন্টু হালদার। হারিয়ে যান অথই জলে।

উত্তম বলেন, ‘রাত তিনটার পর বাবা আর ভাইকে খোঁজা শুরু করি। ভোররাতে বাবার লাশ পাওয়া গেল সুন্দরবনের কেওড়াগাছের ডালে। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত। লাশ চরে রেখে ভাইয়ের সন্ধান শুরু করি। সুন্দরবনের ছোট খাল ও নদীতে কয়েকজন জেলের লাশ মিলল। মনের ভেতর অন্য রকম আশঙ্কা, মিন্টুও কি তবে মারা গেছে? বেলা তিনটার দিকে দুবলার চরের কাছে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। মিন্টুকে সুস্থ করে বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশে ১৭ নভেম্বর বিকেলে ট্রলারে উঠি।’

উত্তমের বাবা গৌর হালদার সেই ১২ বছর বয়স থেকে সাগরে যাচ্ছেন। বাবা বাড়িতে থাকতে চাইতেন না। সাগর সব সময় টানত। কীভাবে সাগরে চলতে হয়, ঝড়-তুফানে রক্ষা পেতে হয় সবই জানা। রেডিও কিংবা টেলিভিশনের সংকেত ছাড়াই ঝড়ের অশনিসংকেত বুঝতেন তিনি। কখন বনের মধ্যে পশুপাখি ছোটাছুটি বা ডাকাডাকি করে, কত অভিজ্ঞতা তাঁর। তবে সেদিন কোনো অভিজ্ঞতাই কাজে আসেনি।

ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোর দুরবস্থা

সিডরের সময় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার দুই উপজেলা আশাশুনি ও শ্যামনগরের ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওই বাঁধগুলো আজও স্থায়ীভাবে মেরামত করা হয়নি। ফলে এসব বাঁধ ভাঙছে প্রতিনিয়ত। বাঁধ ভেঙে শ্যামনগরের গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বিস্তর ফসলসহ বিভিন্ন সম্পদের।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক বলেন, বরাদ্দের অভাবে স্থায়ীভাবে বাঁধ সংস্কার করা যায়নি। তবে স্থায়ী সংস্কারের জন্য প্রকল্প করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পাস হয়ে বরাদ্দ এলেই কাজ শুরু হবে।