আগের দুই বছরও প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি হয়

এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগের রাতেই ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সেই রাতে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রলীগ নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদে এবার জানা গেল, আগের দুই বছরেও ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি হয়েছিল। কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে কিছু পরীক্ষার্থীকে উত্তর সরবরাহ করা হয়। এসব ঘটনায় সিআইডি ৭ শিক্ষার্থীসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানাতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মালিবাগ কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে বলা হয়, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার অভিযোগে গত সোমবার গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত শিক্ষার্থীকে আটক করে সিআইডি। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীসহ চারজনকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়েছে। এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনজনকে।

ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্‌ হল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মহিউদ্দীন এবং অমর একুশে হলের নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি। পরীক্ষার হল থেকেও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মহিউদ্দীন ও মামুনের কাছ থেকে জব্দ করা মুঠোফোনের হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন ব্যক্তির আইডিতে প্রশ্নপত্র পাঠানোর ছবি, প্রবেশপত্র ও রোল নম্বর পাওয়া যায়। পরে মহিউদ্দীন ও মামুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

গতকালের সিআইডির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মহিউদ্দীন ও মামুনের জবানবন্দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিদ আনজুমসহ বেশ কয়েকজনের নাম আসে। এই স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে ১ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁও থেকে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিকে আটক করা হয়। ৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় আনিন চৌধুরীকে। নাভিদ আনজুম ডিজিটাল ডিভাইস সরবরাহ এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার ‘মূল হোতা’।

১৪ নভেম্বর রংপুরের কামালকাছনা বাজার থেকে নাভিদ আনজুমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে গত সোমবার রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম ও আসলামউদ্দিনের নেতৃত্বে সিআইডির দুটি দল গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে এনামুল হক নামে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আটক করে।

নাভিদ ও এনামুলের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে টাকার বিনিময়ে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি এবং পরীক্ষার আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধ উপায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সহায়তা করেছেন। এভাবে অবৈধ উপায়ে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের সাত শিক্ষার্থীকে গত সোমবার গভীর রাতে আটক করা হয়।

আটক ব্যক্তিরা হলেন অর্থনীতি বিভাগের তানভীর আহমেদ মল্লিক, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মো. বায়জিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নাহিদ ইফতেখার ও রিফাত হোসাইন, স্বাস্থ্য অর্থনীতির ফারদিন আহমেদ সাব্বির, সংস্কৃতি বিভাগের প্রসেনজিৎ দাস ও বিশ্বধর্ম সংস্কৃতি বিভাগের আজিজুল হাকিম। তাঁরা সবাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, গত বছর ভর্তি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, স্যার এ এফ রহমান হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল ও জগন্নাথ হলে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা গত বছর ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এখন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসনের সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের ধরতে পেরেছে।

সিআইডির বিশেষ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা নাভিদ আনজুম ও এনামুল হক দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর বলে দিয়ে এবং পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে সহযোগিতা করে আসছিলেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের পর নাভিদ আনজুমকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে নাভিদ আনজুম পরীক্ষার আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ উপার্জন এবং টাকার বিনিময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে দুটি কলেজের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা সিআইডিকে বলেছেন, চক্রের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁওয়ের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পাবনার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রি করে আসছিলেন। এ ছাড়া তাঁরা উত্তরপত্র ডিভাইসে পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে সহযোগিতা করে আসছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি করে ছাত্র ভর্তি করার সঙ্গে জড়িত চক্রের এ পর্যন্ত সাতজনকে এবং জালিয়াত চক্রের সাত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চক্রের হোতা এনামুল ও সাত শিক্ষার্থীকে রিমান্ডে এনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হবে।