ছেলের লাশ দাফন করতে পারেননি বাবা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা বৃদ্ধ আমির হোসেনসহ (ডানে) অন্যরা। ছবিটি গতকাল দুপুরে টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ত্রাণকেন্দ্র থেকে তোলা l প্রথম আলো
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা বৃদ্ধ আমির হোসেনসহ (ডানে) অন্যরা। ছবিটি গতকাল দুপুরে টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ত্রাণকেন্দ্র থেকে তোলা l প্রথম আলো

৬২ বছরের বৃদ্ধ আমির হোসেন। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন জন্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে। যাবেন কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে। অন্যদের সঙ্গে একটি খোলা জিপে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যে কেই তাঁর স্বজন নয়। একমাত্র ছেলে আর ছেলেবউ ও নাতিকে নিয়েই ছিল তাঁর পরিবার। তাঁদের কেউ আর নেই। পালানোর সময় ছেলের লাশটা পড়ে থাকতে দেখেছেন। কিন্তু লাশ দাফন করে আসার সুযোগ পাননি।

কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ত্রাণকেন্দ্রে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আমিরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে কষ্ট আর যন্ত্রণায়। শেষ বয়সে এসে কষ্টটা আরও বেড়ে গেছে। মিয়ানমারে দিনমজুরির কাজ করতাম। স্ত্রী সায়েরা খাতুনকে হারিয়েছি ১৫ বছর আগে। দুই মেয়ে ফরিদা বেগম (৩৬) ও রমিদা বেগমের (৩৫) বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। একমাত্র ছেলে জাবের হোসেনের (৩২) সংসারে বাস করতাম। হঠাৎ করে গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের গ্রামে সেনাবাহিনী ও মগেরা হামলা চালায়।’

রাখাইনের বুচি ডং শহরের অং ডং নামের এ গ্রামে কোনো কথা ছাড়াই গুলি ছোড়া শুরু করে সেনাসদস্য ও মগেরা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একের পর এক ঘরবাড়ি। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় আমিরের ছেলের বউ ও ছোট নাতির। কোনো রকমে ঘর থেকে বের হন আমির ও তাঁর ছেলে জাবের হোসেন। কিন্তু পালানোর সময় সেনাসদস্যদের সামনে পড়েন জাবের। গুলিতে নিহত হন তিনি। আমিরও অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ঘণ্টা দেড়েক পরে চেতনা ফেরে। দেখতে পান, নিজের শরীরের ওপর গ্রামের দুই যুবকের নিথর দেহ। ততক্ষণে হামলাকারীরা গ্রাম ছেড়েছে।

আমির হোসেন বলেন, ‘উঠে দেখি অর্ধশতাধিক লাশ পড়ে আছে। অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ ও গলা কাটা। ছেলের লাশটি দেখলেও দাফন করার উপায় ছিল না। ওখানেই ফেলে রেখে অন্যদের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হাঁটতে পারছিলাম না। বয়সের ভারে ও ছেলের লাশসহ এতগুলো গ্রামবাসীর মৃতদেহ দেখে আমার পায়ের জোর হারিয়ে যায়। এ অবস্থাতেই ১৯ দিন হেঁটে হেঁটে পাহাড় ও জঙ্গল পেরিয়ে চলে আসি মংডু শহরের দংখালী সীমান্তের বালুরচরে।’

আমির হোসেন ভেলায় করে গত রোববার সাবরাং নয়াপাড়া এলাকা দিয়ে শিশু, নারীসহ ৭৭ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। তবে নাফ নদীর জলসীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে বিজিবির বাধার মুখে পড়ে ভেলাটি। এ অবস্থায় নাফ নদীতে ১৩ ঘণ্টা ভাসমান ছিলেন তাঁরা। এরপর রাতে সাবরাং নয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

আমির হোসেন বলেন, ‘আমি এখন বাংলাদেশে আছি। কিন্তু এখনো মনে হয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমার পেছনে অস্ত্র হাতে ছুটে আসছে।’