ভোটের আগে বর্ধিত অংশে বঞ্চনা-প্রাপ্তির হিসাব

বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ওপর টিনের ছাউনির ঘর মানেকা বেগমের। রংপুর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে কোবারু গ্রামে তাঁর এই ঘর অন্যের জমিতে। নিজের জমি নেই। স্বামীও নেই। এক ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মানেকা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তিনি বললেন, তাঁর প্রধান ভরসা ছিল ভিজিডি কার্ড। মাসে ৩০ কেজি চাল পেতেন। কিন্তু কোবারু গ্রাম সিটি করপোরেশন হওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।

২০১২ সালে রংপুর পৌরসভা সিটি করপোরেশন হওয়ার সময় এর সঙ্গে সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ এবং দুটি ইউনিয়নের আংশিক বর্ধিত অংশ হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়। আদতে অজপাড়াগাঁ কোবারুও অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রামটি পড়েছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। কোবারু ছিল পরশুরাম ইউনিয়নে। সিটি করপোরেশনের অংশ হওয়ায় মানেকা বেগমের মতো গ্রামটির বিউটি বেগম, জরিনা বেগম, জামিলা খাতুন, সোফিয়া খাতুন, মনোয়ারা বেগম, মুর্শিদা আক্তারসহ অন্তত ৪০ জনের ভিজিডি (ভারনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট) কার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে আরও অন্তত ছয় রকমের সরকারি সহায়তা। কারণ, এসব সুবিধা শুধু ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য।

গত কয়েক দিনে খোঁজ করে জানা গেল, ইউনিয়নগুলো সিটি করপোরেশনের অধিভুক্ত হওয়ায় ভিজিডি কার্ড ছাড়া বন্ধ হওয়া অন্য ছয় সহায়তা হলো দুস্থ ব্যক্তিদের জন্য ভিজিএফ (ভারনারেবল গ্রুপ ফিডিং), দরিদ্র নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য), ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি এবং গ্রামীণ এলাকায় ৬০ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ সেতু-কালভার্ট নির্মাণকাজ।

এই সহায়তাগুলো বন্ধ হওয়ায় দরিদ্র নারীরা যেমন সরাসরি খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি নিম্নআয়ের নারী ও পুরুষদের কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়ে গেছে। টিআর, কাবিখা ও সেতুর কাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ব্যাপক সংখ্যায় মাটি কাটার কাজ করতেন। এই কাজের সুযোগ হারিয়ে নারীরা কষ্টে পড়েছেন বেশি।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই বর্ধিত এলাকায় কিছু সড়কবাতি, অল্প কিছু নতুন সড়ক ছাড়া বিশেষ কোনো উন্নতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। সংস্কার না হওয়ায় ইউনিয়ন আমলের রাস্তাও ভেঙে গেছে। অথচ আবাদি জমির খাজনা ৩ টাকা শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে। বর্ধিত এলাকাগুলোর জন্য সিটি করপোরেশনের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে আলাদা করে খাত উল্লেখ নেই। ফলে সেখানে কত বরাদ্দ ছিল, তা জানা যায় না।

সিটি করপোরেশন হওয়ার পর কী পেলেন আর কী হারালেন—বর্ধিত অংশের ভোটাররা এই হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে।

কোবারু, বাহাদুর সিংহ ও চব্বিশ হাজারি গ্রাম ঘুরে ভিজিডি, ভিজিএফ, টিআর, কাবিখা—এসব বন্ধ হওয়া নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত পাঁচ বছরে তাঁদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। জামিলা খাতুনের স্বামী আবদুল হামিদ স্থানীয় বুড়িরহাটে নৈশপ্রহরীর কাজ করেন। আগে জামিলা ভিজিডি কার্ডে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল পেতেন। মাটি কাটার কাজও করতেন। পাঁচ বছর ধরে সব বন্ধ। বাহাদুর সিংহ গ্রামের জামিলা বললেন, ‘সিটি হওয়ার আগত হামরাগুলা ভালো আছনো। আগত অনেক কিছু পাছনো। কিন্তু এলা কিছুই পাই না।’

কোবারু গ্রামের মজিদা, সাগরিকারা আগে টিআর, কাবিখায় নিয়মিত মাটি কাটার কাজ করে মাসে অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করতেন। এখন তাঁদের নিয়মিত কোনো কাজ নেই। সাগরিকা বলছিলেন, ‘শুনছিনো সিটি হইলে হামার কপাল ফিরবে। এলা হামার যে এত কষ্ট, কাঁয়ও দেইখবার আইসে না।’

গ্রামের পথেই দেখা হয় গণসংযোগে আসা এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, এসব গ্রামের সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এলাকার তো কোনো উন্নতি হয়নি, গরিব লোকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখানে ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখা, টিআর ইত্যাদি মিলিয়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার নারী-পুরুষ সুবিধাভোগী ছিলেন। তাঁরা যে বঞ্চিত হলেন, সে বিষয়টি সামনে আসে না। সিটি করপোরেশনের বর্ধিত অংশে এমন বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা অনেক।

ভিজিডি ও মাতৃত্বকালীন ভাতার বিষয়টি জেলা পর্যায় থেকে তত্ত্বাবধান করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। তাদের রংপুর জেলা কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, ২০১২ সালে সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ভিজিডি কার্ডধারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৫৩। বর্ধিত অংশে মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা ছিল কমবেশি ৩১৯।

জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা কাওসার পারভিন বললেন, গর্ভবতী মায়েরা টানা দুই বছর প্রতি মাসে আগে ৩৫০ টাকা পেতেন, এখন ৫০০ টাকা করে পাচ্ছেন।

টিআরে দিনে সাত ঘণ্টা কাজের মজুরি হিসেবে ৮ কেজি চাল দেওয়া হয়। কাবিখাতে মজুরি হিসেবে প্রতি ঘনমিটারে ২ দশমিক ৪৮৯ কেজি চাল দেওয়া হয়। এ ছাড়া মঙ্গা বা কর্মহীন সময়ে দরিদ্রদের বিশেষ সহায়তা হিসেবে বছরে দুই দফায় ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচির কাজে প্রতিদিনের মজুরি ২০০ টাকা। গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণের জন্য ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে বিনা মূল্যে সাধারণত বছরে তিনবার (ক্ষেত্রবিশেষে এর অধিক) ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।

এসব সহায়তা তত্ত্বাবধান করে জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়। রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা ফরিদুল হক বললেন, সিটি করপোরেশনভুক্ত হওয়ার পরপরই ওই বর্ধিত অংশের সব সহায়তা স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিয়নগুলোতে প্রতিবছরই টিআর, কাবিখার বরাদ্দ বাড়ে। এ দুটি সুবিধা চালু থাকলে বর্তমানের হিসাবে বর্ধিত অংশের অন্তত ৩ হাজার ৭২ জন শ্রমিক ১০০ দিনের কাজের সুবিধা এবং প্রায় ২ হাজার ৮০০ জন ভিজিএফ কার্ডের সুবিধা পেতেন।