বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান

তিন দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরে পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ l ছবি: রয়টার্স
তিন দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরে পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ l ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গা সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এ সংকট সমাধানের জন্য বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। মিয়ানমার ঘুরে বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিন রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য এই আহ্বান জানান।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পোপ ফ্রান্সিস ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে যান। মিয়ানমার সফরেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাঁর সমালোচনা করছে।

শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে পোপ ফ্রান্সিস গতকাল তিন দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছান। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং মেঘদূতে চড়ে বেলা তিনটার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান পোপ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। সেখান থেকে তিনি ধানমন্ডিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পর দরবার হলে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে তিনি বক্তৃতা করেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উদার মন এবং অসাধারণ সংহতির পরিচয় দিয়েছে। এটা ছোট কোনো বিষয় নয়, বরং পুরো বিশ্বের সামনেই ঘটেছে। পুরো পরিস্থিতি, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু, তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি।’

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মিয়ানমারে নিপীড়িত মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে পোপের অবস্থানকে ‘প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করে বলেন, ক্যাথলিক ধর্মগুরুর এই অবস্থান সংকট সমাধানে আশা দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের সাহায্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার ঐকান্তিক আহ্বান এ বিষয়ে দ্রুত ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নৈতিক বাধ্যতা দেয়।

এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসাটা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন পোপ। তিনি বলেন, ‘কঠিন এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের সমাধানই নয়, বাংলাদেশে দ্রুত মানবিক সহায়তাও দিতে হবে।’

তিন দিনের বাংলাদেশ সফরে পোপ ফ্রান্সিসের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের কর্মসূচি না থাকলেও ঢাকায় রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা রয়েছে বলে বাংলাদেশের খ্রিষ্টান নেতারা জানিয়েছেন।

 বঙ্গভবনে সুধী সমাবেশে আহ্বান
 উচ্চারণ করেননি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি
 বাংলাদেশকে দ্রুত মানবিক সহায়তা দিতে হবে
 সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন


পোপের সামনে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাদের সরকার প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের নিজেদের আবাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। নারী-শিশুসহ হাজারো মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি ভস্মীভূত হতে তারা নিজ চোখে দেখেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংসতার কারণে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের জনগণ তাদের খোলা মনে স্বাগত জানিয়েছে। খাদ্য-আশ্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে।’

পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যদিও আমার সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়া, তারপরও আগামীকাল রমনায় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে শান্তির জন্য প্রার্থনা করব এবং শান্তির জন্য কাজ করতে আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করব। মানবজাতির সদস্য হিসেবে আমাদের একে অন্যকে প্রয়োজন এবং পরস্পরের ওপর নির্ভর করতে হয়।’

ভাষণের শুরুতেই সফরের আমন্ত্রণ জানানোয় রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান পোপ ফ্রান্সিস। দুই পূর্বসূরি পোপ ষষ্ঠ পল, পোপ দ্বিতীয় জন পলের বাংলাদেশ সফরের কথাও স্মরণ করেন তিনি।

বাংলাদেশের জাতির জনকের কথা উল্লেখ করে পোপ বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান আধুনিক, বহুত্ববাদী এবং অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ এবং জাতি মুক্ত, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারবে, যেখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমান অধিকার থাকবে।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের প্রশংসা করেন পোপ। তবে বিভক্তি তৈরি করতে কখনো কখনো ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত বছর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার কথাও স্মরণ করেন তিনি।

বাংলাদেশে ক্যাথলিকরা সংখ্যায় কম হলেও স্কুল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে মন্তব্য করে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন পোপ।

সফরের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক প্রার্থনা সভায় পৌরোহিত্য করবেন পোপ ফ্রান্সিস। এরপর ভ্যাটিকান দূতাবাসে গিয়ে পোপের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে তিনি যাবেন কাকরাইলের রমনা ক্যাথিড্রালে, সেখানে আর্চবিশপ হাউসে বিশপদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরে আন্তধর্মীয় ও আন্তমান্ডলিক সমাবেশে যোগ দেবেন।

সফরের শেষ দিন আগামীকাল শনিবার সকালে তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা হাউস পরিদর্শনে যাবেন পোপ। এরপর তেজগাঁওয়ে হলি রোজারিও চার্চে খ্রিষ্টান যাজক, ধর্মগুরু ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে চার্চের কবরস্থান পরিদর্শন করবেন। দুপুরের পর ঢাকায় নটর ডেম কলেজে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি।

রোববার বিকেলে পোপের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে ক্যাথলিক ধর্মগুরুকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ভ্যাটিকানের ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত হন ফ্রান্সিস। রোমের বিশপ হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চ এবং সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান।

তিন দশক পর এই প্রথম কোনো পোপ বাংলাদেশ সফরে এলেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল।