পদ্মা সেতু ইংরেজি 'এস' বর্ণের হবে

শীতের আগমনে এখন বেশ শান্ত পদ্মা। ঢেউ নেই, স্রোত নেই। রোদেলা দুপুরের কিছুটা সময় বাদ দিলে ভোর থেকে রাত—ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে পদ্মার দুই পাড়। তবে শান্ত পদ্মার এপার-ওপারে ঝিমুনি নেই; বরং রাত-দিন সব সময় সবার মধ্যে ব্যস্ততা। পদ্মা পাড়ের তিন হাজার শ্রমিকের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি। ‘পদ্মা সেতু’ নামের একটি স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে তাঁদের এই ব্যস্ততা। তাঁদের ঘাম-ঝরানো শ্রমে গড়ে উঠছে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু।

পদ্মাসেতুর ওপর বসানো প্রথম স্প্যান। ছবি: হাসান রাজা
পদ্মাসেতুর ওপর বসানো প্রথম স্প্যান। ছবি: হাসান রাজা

এরই মধ্যে একটি স্প্যান বসানোয় চোখের সামনে ফুটতে শুরু করেছে পদ্মা সেতু। পদ্মা পাড়ি দেওয়ার সময় অনেকে হয়তো মনে মনে পুরো সেতুটির একটি কল্পচিত্র এঁকে ফেলেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ভাবছেন—পদ্মা সেতুর পথ হবে একেবারে লম্বা। কেউ ভাবছেন বাঁকা। কল্পদৃশ্যে কোনোটিই ঠিক না–ও হতে পারে। কারণ, পদ্মা সেতুর রূপ হবে ইংরেজি ‘এস’ বর্ণের মতো। এমনটিই জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এস’ বর্ণের আদলেই গড়ে তোলা হচ্ছে পদ্মা সেতু। এই বর্ণের মতো করেই একের পর এক স্প্যান বসানো হবে।

সেতু নির্মাণে চলছে ভারী ক্রেনের কাজ। ছবি: হাসান রাজা
সেতু নির্মাণে চলছে ভারী ক্রেনের কাজ। ছবি: হাসান রাজা

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মার বুকে ৪২টি খুঁটি (পিলার) থাকবে। এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। খুঁটিগুলোর ওপর মোট ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। প্রতিটি স্প্যান ইস্পাতের তৈরি। সব স্প্যান জোড়া দিয়েই তৈরি হবে পদ্মা সেতু।

দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি দীর্ঘ হবে প্রায় সাড়ে ৯ কিলোমিটার। প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার দীর্ঘ, ১২ মিটার প্রশস্ত। এই ১২ মিটারের ওপর কংক্রিটের ২২ মিটারের ডেক বসানো হবে। সেতুর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন।

সেতুর প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, পানির উচ্চতা যতই বাড়ুক না কেন, পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে পাঁচতলার সমান উচ্চতার যেকোনো নৌযান সহজেই চলাচল করতে পারবে।

পদ্মাসেতুর ওপর বসানোর জন্য প্রস্তুত স্প্যান। ছবি: হাসান রাজা
পদ্মাসেতুর ওপর বসানোর জন্য প্রস্তুত স্প্যান। ছবি: হাসান রাজা

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। স্প্যানের বিম তৈরি করা হচ্ছে চীনের শিং হোয়াং দাও নামের একটি শহরে। সেখান থেকে বিমগুলো জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়ে আনা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর থেকে সোজা পদ্মার মাওয়া প্রান্তে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে আনা হয়। এখানে বিম সংযোজন করে স্প্যান প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন চীনা প্রকৌশলীরা।

কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে গত বুধবার দেখা গেল, আরও নয়টি স্প্যান প্রস্তুত হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি স্প্যান ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হবে। সোনালি রঙের স্প্যানটির লোড টেস্ট করানো হয়েছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেলে, কয়েক দিন পর ধূসর রঙের প্রলেপ দেওয়া হবে। এরপর ৩ হাজার ৭০০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন দিয়ে মাওয়া থেকে এটি আনা হবে জাজিরা প্রান্তে।

পদ্মাসেতুর ভারী সরঞ্জাম স্থানান্তরে ব্যবহার করা হচ্ছে এই ক্রেন। ছবি: হাসান রাজা
পদ্মাসেতুর ভারী সরঞ্জাম স্থানান্তরে ব্যবহার করা হচ্ছে এই ক্রেন। ছবি: হাসান রাজা

তবে ‘এস’ বর্ণের রূপে পদ্মা সেতু হলেও খালি চোখে তাকালে স্প্যানগুলোকে বাঁকা দেখা যাবে না, বোঝাও যাবে না। স্প্যানগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ একই মাপের। কিন্তু খুঁটির ওপর বসালে ‘এস’ বর্ণের মতো হয়ে যাবে স্বপ্নের ওই সেতু।

যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু ৫ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। তবে এটি ইংরেজি ‘সি’ বর্ণের মতো একটি বাঁক রেখে নির্মাণ করা হয়েছিল। পদ্মা সেতুটি কেন ‘এস’ বর্ণের মতো করে গড়া হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো লম্বা সড়ক কিংবা বড় ব্রিজ (সেতু) সোজা হয় না। চাইলেও সেটি করা হয় না। এর কারণ হলো সোজা পথ থাকলে যানবাহনের চালকের ঝিমুনি আসতে পারে। তাঁরা যেন চলার সময় সতর্ক থাকেন, এ জন্য কিছুটা বাঁক দেওয়া হয়। আরেকটি বিষয় হলো সৌন্দর্যবোধ। যে কোনো স্থাপনা ডিজাইনে সৌন্দর্যের ব্যাপার রয়েছে। যমুনা সেতুতে একটি হালকা বাঁক রয়েছে। তেমনি করে পদ্মা সেতু ‘এস’ বর্ণের মতো ডিজাইন করা হয়েছে।’

এভাবেই গড়ে উঠছে সেতুর মোটা মোটা পিলার। ছবি: হাসান রাজা
এভাবেই গড়ে উঠছে সেতুর মোটা মোটা পিলার। ছবি: হাসান রাজা

২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এই কাজের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে।

সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে সেতু বিভাগ। সেই পরিকল্পনায় চার বছরে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে।

পদ্মা সেতুর ৪০ নম্বর পিলারের ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ছবি: হাসান রাজা
পদ্মা সেতুর ৪০ নম্বর পিলারের ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ছবি: হাসান রাজা

সে লক্ষ্যেই পদ্মা সেতুর কাজ চলছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মানুষ টার্গেট (লক্ষ্য) নিয়েই কাজ করে। টার্গেট না থাকলে কোনো কাজ তো হবে না। আমরা চেষ্টা করছি টার্গেটটা পূরণ করার জন্য। এখনো আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরও কিছুদিন পর বলতে পারব যে আসলে আমরা কী করতে পারি। সময়মতো, নাকি আর কিছুদিন লাগবে, সেটা আর কিছুদিন পর বলতে পারব। চেষ্টা করে যাচ্ছি টাইম ঠিক রাখার জন্য। কিন্তু বলাটা ঠিক না যে শতভাগ পারব, পারব না—কোনোটাই বলতে পারছি না। আরও দুই-চার মাস পর পুনর্মূল্যায়ন করতে পারব যে আমরা আসলে কোথায় আছি।’