এইচআইভি প্রতিরোধে তিন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না

জাতিসংঘের এইচআইভি/এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএন এইডস বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষ ১২ হাজার। তাঁদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বা ১০ হাজার ৮০ জন এইডসের ওষুধ (এআরভি বা অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল) পাচ্ছেন না। যে অল্পসংখ্যক মানুষ ওষুধ পাচ্ছেন, তাঁরা নির্ণয় যন্ত্রের অভাবে রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতির মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারছেন না।

সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি ও ইউএন এইডসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ এইচআইভি/এইডসবিষয়ক বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। রোগী শনাক্ত করা, রোগীদের চিকিৎসা এবং ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ রাখার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। বর্তমানে এআরভি সেবনকারীদের শারীরিক পরিস্থিতির তথ্য সরকারের কাছে নেই।

বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পরিস্থিতি এমন হয়েছে। একশ্রেণির কর্মকর্তার জবাবদিহির অভাব আছে। কারও মধ্যে তথ্য গোপন করার প্রবণতা আছে।’

তিন লক্ষ্যমাত্রা
২০১১ সালে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে ২০৩০ সালের মধ্যে এইডস নির্মূলের বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ তাতে স্বাক্ষরদানকারী দেশ। প্রতিশ্রুতি পূরণে তিনটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। বলা হয়: ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশে এইচআইভি নিয়ে বসবাসকারী ৯০ শতাংশ মানুষ শনাক্ত করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলেও বাংলাদেশ পারেনি। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের অনুমিত সংখ্যা ১২ হাজার। ইউএন এইডসের গত জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৩৪ শতাংশ বা ৪ হাজার ৮০ জন। ১০ হাজার ৮০০ জন শনাক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে শনাক্তকৃত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশকে এআরভির মাধ্যমে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এআরভি পান ৪৬ শতাংশ বা অর্থাৎ ১ হাজার ৮৭৭ জন। এআরভি পাওয়ার কথা ছিল ৩ হাজার ৩৭২ জনের।

তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে এআরভির আওতায় থাকা ৯০ শতাংশ রোগীর শরীরে ভাইরাস অবদমিত অবস্থায় থাকবে। ভাইরাস অবদমিত অবস্থায় থাকলে রোগী কর্মক্ষম থাকেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তথ্য সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। ইউএন এইডস প্রতিটি দেশের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতেও এ-সম্পর্কিত তথ্য নেই।

ইউএন এইডসের হিসাব বলছে, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রার কোনো তথ্যই নেই। এ ব্যাপারে জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ডা. মো. বেলাল হোসেন গত ২৯ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি ঠিকই; কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’

যন্ত্র কাজে আসছে না
অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ভাইরাসের পরিমাণ (ভাইরাল লোড) জেনে এইচআইভি/এইডস রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। সাধারণত এক মিলিলিটার রক্তে ভাইরাসের সংখ্যা জেনে ওষুধের পরিমাণ (ডোজ) নির্ধারণ করা হয়।

চিকিৎসক মো. বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভাইরাল লোড পরিমাপের যন্ত্র দেশে আছে দুটি। একটি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর)। অন্যটি বিএসএমএমইউতে।

আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের যন্ত্রটি শুধু রক্তের নমুনাভিত্তিক জরিপের সময় ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, ছয় মাসের বেশি যন্ত্রটি পড়ে আছে। আনুষঙ্গিক রাসায়নিকের (রিএজেন্ট) অভাবে যন্ত্রটি চালানো যাচ্ছে না।

বর্তমানে দেশে কোনো এইডস রোগীর ভাইরাস পরিস্থিতি জানা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় দেড় দশক ধরে এইচআইভি/এইডস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন এমন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এইচআইভি/এইডস রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে আন্দাজে, অনেকটা হারবাল বা কবিরাজি চিকিৎসার মতো।

এইডস পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এইডসে দেশে মোট ৭৯৯ জনের মৃত্যু হয়। বর্তমানে বছরে প্রায় দেড় শ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এইডসে। ২০১৬ সালে দেশে ৫৭৮ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়, এঁদের ৩২ শতাংশ কোনো না কোনো সময় দেশের বাইরে ছিলেন।

সর্বশেষ রক্তের নমুনাভিত্তিক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ ২২ শতাংশ এবং চানখাঁরপুল এলাকায় ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কোনো জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ সদস্য এইচআইভি সংক্রমিত হলে পরিস্থিতিকে ‘ঘনীভূত মহামারি’(কনসেনট্রেটেড এপিডেমিক) বলে। এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত ভাইরাস বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।

এইডস দিবস আজ
আজ বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও প্রতিবছর সরকারিভাবে বিশ্ব এইডস দিবস পালন করে। এই দিনে দেশের সর্বশেষ এইডস পরিস্থিতি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দেশের বাইরে থাকায় আজ কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হবে ৬ ডিসেম্বর।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, এইডস দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, এইডসের সহজলভ্য এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

আর প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে এইডস নির্মূলে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন-সহযোগী ও অন্য সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।