৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে নিকোটিন

বাংলাদেশের শিশুদের বিরাট অংশ ধূমপানের বিষক্রিয়ার শিকার। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন আছে। পরোক্ষ ধূমপান নিকোটিন উপস্থিতির কারণ।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ছয়টি ও সাভার এলাকার ছয়টি প্রাথমিক স্কুলের ৪৭৯টি শিশুর লালা পরীক্ষায় ক্ষতিকর নিকোটিন পাওয়া গেছে। গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে ৭ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছে। ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার: ঢাকা, বাংলাদেশে একটি জরিপ’ (সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ) শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের ওপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় বাবা, বড় ভাই বা অন্য কেউ ধূমপান করে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকে সিগারেট খান, সেই ধোঁয়া যায় শিশুর শরীরে। এই পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব নিয়েই আমাদের গবেষণা।’

গবেষণা ফলাফলকে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক অধ্যাপক আলী হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ এই পরোক্ষ ধূমপান। বাবা, বড় ভাই বা পথচারী যে ধোঁয়া ছাড়ছে, তার শিকার হচ্ছে শিশুরা। ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার উপায় নেই।’

ধূমপায়ীরা যে ধোঁয়া ছাড়ে, তা নিশ্বাসের সঙ্গে অন্যের শরীরে প্রবেশ করে। এটাই পরোক্ষ ধূমপান। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বহু গবেষণায় শিশু স্বাস্থ্যে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। একই পরিবেশে পরোক্ষ ধূমপানে স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের বেশি, কারণ বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেশি। আশপাশে কেউ ধূমপান করলে তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা শিশুদের তুলনামূলকভাবে কম।

গবেষণা পদ্ধতি

রুমানা হক বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) অনুমোদন নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। ১২টি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুদের অধিকাংশের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে।

দুইভাবে শিশুর তথ্য নেওয়া হয়। প্রথমত শিশুদের লালা সংগ্রহ করা হয়। এই লালা বিশেষ ব্যবস্থায় যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। যুক্তরাজ্যের এবিএস ল্যাবে এই লালা পরীক্ষা করা হয়। রুমানা হক বলেন, ‘নিকোটিনের উপস্থিতি পরীক্ষার কোনো ল্যাবরেটরি বাংলাদেশে নেই বলে যুক্তরাজ্যে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল।’ তিনি বলেন, শরীরে নিকোটিনের উপস্থিতি লালা, প্রস্রাব বা চুলের গোড়া পরীক্ষায় শনাক্ত হয়।

লালা পরীক্ষার পাশাপাশি প্রত্যেক শিশুর জন্য প্রশ্নপত্র ব্যবহার করা হয়। ‘তুমি যাদের সঙ্গে বসবাস করো, তাদের কেউ কি ধূমপান করে? বা তোমার বাবা বা মা কি ধূমপান করেন?’... এ ধরনের প্রশ্ন তাতে ছিল।

গবেষণায় কী পাওয়া গেছে

৪৭৯ শিশুর মধ্যে ৪৫৩টি শিশুর লালায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৯৫ শতাংশ শিশু। এক প্রশ্নের উত্তরে রুমানা হক বলেন, ‘বিড়ি, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া শিশুর শরীরে নিকোটিন প্রবেশের আর কোনো উৎস নেই। গাড়ি বা কলকারখানার ধোঁয়া বা অন্য কোনো উৎসে নিকোটিন থাকে না।’

রুমানা হক আরও বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের গবেষণার নজির তাঁর বা তাঁর সহগবেষকদের জানা নেই। তাই পরিস্থিতি তুলনা করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০১১ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটে বলে হয়েছিল, বিশ্বব্যাপী ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। সেই তথ্যের উদ্ধৃতি বর্তমান প্রবন্ধে আছে। তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বৈশ্বিক পরিস্থিতির চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ।

গবেষণায় ৪৩ শতাংশ শিশু (২০৮ জন) বলেছে, তার পরিবারে কমপক্ষে একজন ধূমপান করে। ২১ শতাংশ শিশু (১০০ জন) বলেছে, তার পরিবারে সদস্যদের ও অতিথিদের ধূমপান নিষেধ। ৮৭ শতাংশ শিশু (৪১৯ জন) বলেছে, তারা সম্প্রতি জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আছে দোকানে, রাস্তায় পরোক্ষ ধূমপান করা।

গবেষকেরা বলছেন, গবেষণাটি এমন একটি দেশে হয়েছে, যে দেশে জনপরিসরে ধূমপানের বিরুদ্ধে আইন আছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জাতীয় পেশাগত কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা ছাড়া আমরা শিশুদের পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারব না। ধূমপান ছাড়তে না পারলেও কেউ যেন বাড়িতে ধূমপান না করেন। অন্যদিকে জনপরিসরে কেউ যেন ধূমপান না করতে পারেন, সে জন্য আইনটির যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।’