সাড়ে ১২-তে মুক্তিযোদ্ধা

জামুকার সব সদস্যের সম্মতি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও চান না। তারপরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়সসীমা আরও ছয় মাস কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। অর্থাৎ সাড়ে ১২ বছরের গেজেটভুক্ত যে-কেউ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন।

জামুকার তিনজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জামুকার দুই প্রভাবশালী সদস্য নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের চাপে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বয়স ৬৮, কিন্তু সনদে দেওয়া আছে ৬৬। ঠিক একইভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা জন্মসনদে বয়স কমিয়ে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁদের বয়স বেশি হলেও এসএসসির সনদে তাঁদের বয়স কম দেখানো হয়েছে। তাই আমি সাড়ে ১২ বছরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছি।’

মোতাহার হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা অনেক আগে থেকে ভাতা পেয়ে আসছিলেন, ১৩ বছর করার ফলে তাঁদের অনেকের ভাতা বাতিল হচ্ছে, তাঁদের সন্তানেরা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে না। সেই বিবেচনায় আমরা বয়স সাড়ে ১২ বছর করার পক্ষে মত দিয়েছি।’

জামুকার ৫০তম সভার কার্যবিবরণীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ছয় মাস প্রমার্জনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সিদ্ধান্ত কার্যকরের ব্যাপারে মতামত জানতে তা প্রস্তাব আকারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ সিদ্ধান্তের পক্ষে নন, তবে জামুকার দু-একজন সদস্যের চাপে এবং বিভিন্ন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পরই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।

জামুকার কার্যবিবরণীতে বয়স কমানোর যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত বয়স ১৩ বছর ধার্য করার কারণে অনেকে সরকারি প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। এমন অনেকে আবেদন করেছেন। তাই ‘কেস টু কেস’ বিবেচনা না করে সবার জন্যই এ প্রমার্জনের (বয়সসীমা কমানো) সুযোগ রাখা হবে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সম্মানী ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামুকার সদস্য, সাবেক সচিব রশিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে ১২ বছরে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হন কী করে? মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য, রাইফেল তোলার জন্য শারীরিক সামর্থ্যের দরকার হয়। তিনি আরও বলেন, ‘দু-একজন বয়স কমাতে এত আগ্রহ কেন দেখাচ্ছেন জানি না। আমি এ সিদ্ধান্তের পক্ষে নই। এটা হওয়া একদম উচিত নয়। এতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাড়বে।’

জামুকার আরেক সদস্য নওগাঁর সাংসদ সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে ঢালাও বয়স কমানো ঠিক হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে। আমি এর পক্ষে মত দিইনি, অনেকেই দেয়নি।’

গত ৪৬ বছরে মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বার পাল্টেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কারা বিবেচিত হবেন, তা প্রথম নির্ধারিত হয় ১৯৭২ সালে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মানদণ্ড কী হবে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেকোনো আবেদনকারীর বয়স ১৯৭১ সালে ন্যূনতম ১৫ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক বলা হয়। এই সিদ্ধান্তের পর ১৩ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম লালু, ১৪ বছর বয়সী তারামন বিবি ও আবু সালেকদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির কী হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেকে দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁদের বয়স ১৫ বছরের বেশি হলেও এসএসসির সনদে তাঁদের বয়স কম দেখানো হয়েছে। এরপর ২০১৫ সালে জামুকার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে তা পরিবর্তন করে আবার বলা হয়, একাত্তরের ৩০ নভেম্বর যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ গত ১৯ অক্টোবর জামুকার বৈঠকে বয়সসীমা আরও ছয় মাস কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোক বলেন, আবারও ছয় মাস কমানো হলে পুরো মুক্তিযুদ্ধ যাচাই-বাছাইপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তিনি বলেন, দু-একজনের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানও হতে পারে। কিন্তু ১৩ বছর থেকে ৬ মাস কমিয়ে তা সবার জন্য করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। বয়স কমানো নিয়ে আলোচনা এবার বন্ধ হওয়া উচিত।