মেজর মনজুরের চশমা

একাত্তরে মেজর মনজুরের ব্যবহৃত চশমা
একাত্তরে মেজর মনজুরের ব্যবহৃত চশমা

ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সযত্নে রক্ষিত মোটা কালো ফ্রেমের একটি চশমা ষাট-সত্তর দশকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। সেকালে ব্যবহৃত প্রায় সব চশমারই এই এক রূপ। কবি আহসান হাবীব কিংবা কবি শামসুর রাহমানের মুখচ্ছবির কথা স্মরণ করুন। শুধু কবি কেন, বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটির যিনি স্থপতি, কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় আমরা যাঁকে মঞ্চে আবির্ভূত হতে দেখি কবিরূপে, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চশমারও এই একই রূপ।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত চশমাটি কোনো কবি বা রাজনৈতিক নেতার নয়। এই চশমা ব্যবহার করতেন একজন সৈনিক, একজন যোদ্ধা, যোদ্ধাদের অধিনায়ক। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদমর্যাদার অফিসার ছিলেন। তিনি মোহাম্মদ আবুল মনজুর।

মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে একজন ‘ব্রিগেড মেজর’ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন মনজুর। চশমাটি প্রসঙ্গে বলতে হয়, অত্যন্ত মেধাবী এই সেনা কর্মকর্তা ছাত্রজীবন থেকেই ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। তাঁর অগ্রজ ব্যারিস্টার আবুল মনসুর আমাকে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় মনজুর পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এবং তিনি সেনাবাহিনী থেকে প্রশাসন বিভাগে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মতো দক্ষ ও মেধাবী সেনা অফিসারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হারাতে চায়নি। মনজুর সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র পাননি।

সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে দেশটির পূর্বাংশের নাগরিকদের ওপর যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তা ব্রিগেড মেজর মনজুরকে বীতশ্রদ্ধ ও ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কী করে পালাবেন? সামরিক কর্তৃপক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালি সেনা অফিসারকে নজরবন্দী করে রেখেছে। তা ছাড়া, তিনি তো শিয়ালকোটে একা থাকেন না, সঙ্গে আছেন স্ত্রী রানা মনজুর আর ছোট ছোট দুই সন্তান। ছোট ছেলেটির বয়স মাত্র কয়েক মাস। এদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব?

পালানোর পথ খুঁজতে খুঁজতে চার মাস পেরিয়ে গেল। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে শিয়ালকোটে তাঁর বাসায় হঠাৎ এসে হাজির হলেন মেজর তাহের, মেজর জিয়াউদ্দীন আর ক্যাপ্টেন আলমগীর। তাঁরা পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢোকার পরিকল্পনা করেছেন। মেজর মনজুরও সপরিবার তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। রাতের অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে কর্দমাক্ত ধানখেতের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে হেঁটে তাঁরা ভারতের পাঞ্জাব সীমান্তে প্রবেশ করেন ২৭ জুলাই। মনজুর কলকাতা পৌঁছান ৭ আগস্ট। ১৮ আগস্ট তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যোগদান করেন।

৮ নম্বর সেক্টর বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের অংশবিশেষ, খুলনা জেলার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। সদর দপ্তর ছিল বেনাপোলে, কিন্তু মূল কমান্ডের দাপ্তরিক কাজকর্ম চলত দূরবর্তী সদর দপ্তর ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তের কাছে কল্যাণী শহরে। সেক্টরটির প্রথম কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, আগস্টের ১৮ তারিখে তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তরে বদলি করে মেজর আবুল মনজুরকে সেই পদে নিযুক্ত করা হয়। ৮ নম্বর সেক্টর ৭টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মেজর মনজুরের চশমার পাশে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তাঁর তৈরি করা একটি নির্দেশনাপত্রও রাখা আছে। এটা তাঁর স্বাক্ষরিত একমাত্র স্মারক। তিন পৃষ্ঠার নির্দেশনাটি ইংরেজিতে টাইপ করা, ৩০.০৯.১৯৭১ তারিখে স্বাক্ষরিত। পাঠানো হয়েছে প্রতিটি সাব-সেক্টরের কমান্ডারকে। নথিটি লক্ষ করলে সেনা অধিনায়ক হিসেবে মেজর মনজুরের পর্যবেক্ষণগুলো আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়। তিনি শুরুতেই লিখেছন, ‘সম্প্রতি সৈন্যদের কোম্পানিগুলো পরিদর্শন করে আমার দৃষ্টিতে কিছু ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা ধরা পড়েছে। এগুলো দূর করার জন্য আশু পদক্ষেপ নিতে চাই।’

যোদ্ধাদের নিয়ম-শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের নিয়ম-শৃঙ্খলার অবস্থা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ হয় অমান্য করা হয়, নয় তো খুবই দায়সারাভাবে পালন করা হয়।’

মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে দৃঢ় নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সেক্টর কমান্ডার মনজুর এসব নির্দেশ জারি করেন: ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী সেনা অফিসারেরাসহ প্রত্যেককে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ৯০ মিনিট শারীরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে। কোনো অজুহাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটানো চলবে না। যাঁরা ক্যাম্পের বাইরে বেরুতে চাইবেন, তাঁদেরকে অবশ্যই কোম্পানি কমান্ডার বা প্লাটুন কমান্ডারের পূর্বানুমতি নিতে হবে।

এসব নির্দেশ সাক্ষ্য দিচ্ছে, সৈনিক হিসেবে দৃঢ় পেশাদারি মনোভাব ছিল মেজর মনজুরের। তাঁর পরিকল্পনা, যুদ্ধকৌশল ও নির্দেশনার ফলে ৮ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙে দিতে সক্ষম হন নভেম্বর মাসের মধ্যেই। এর ফলে ভারতীয় বাহিনী সহজেই যশোর অঞ্চলে ঢুকে পড়তে পেরেছে এবং ডিসেম্বরের ৬ তারিখেই ওই এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছিল।