জানালার সঙ্গে বেঁধে দিনে তিনবার পেটানো হতো

কেশবপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা। ছবি: দিলীপ মোদক
কেশবপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা। ছবি: দিলীপ মোদক

খেলাঘর আসরের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শিশুসংগঠক আবদুল মজিদকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে জানালার সঙ্গে বেঁধে দিনে তিনবার পেটানো হতো। শরীর থেকে রক্ত ঝরত। একপর্যায়ে মূর্ছা যেতেন। এরপর তাঁকে গুলি করে হত্যার ফরমান জারি করা হয়। সেসব দিনের ভয়ংকর স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়া করে। আজও তাঁর শরীর কাঁটা দেয়, শিউরে ওঠেন তিনি।

যশোরের কেশবপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার কেশবপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সাতজন ভুক্তভোগী একাত্তরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার সেসব দিনের কথা বলেন। এই সেই বিদ্যালয়, একাত্তরে রাজাকারেরা এখানে তাঁদের আটকে রেখে পিটিয়ে অজ্ঞান করত। উপজেলা প্রশাসন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

আবদুল মজিদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে আমি ভারতে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুবোধ মিত্র আমাকে ডেকে কিছু চিঠি দিয়ে বললেন, কেশবপুর ও মনিরামপুর এলাকায় এগুলো পৌঁছে দিয়ে আসার পর আমাকে প্রশিক্ষণে পাঠাবেন। আমি চিঠি নিয়ে আসি। লোক মারফত সেগুলো বিলি করি। এরপর মজিদপুর গ্রামে আমার মাকে দেখতি আসি। মা আমাকে দেখেই বলেন, বাজান, তুমি চলে যাও। রাজাকাররা প্রতি রাতেই তোমারে খুঁজতে আসে। তুমি এখনই চলে যাও। তোমাকে পেলেই ওরা মেরে ফেলবে। রাতটা আমি থাকতে চেয়েছিলাম। মাকে বলেছিলাম, পরদিন সকালে আমি চলে যাব। কিন্তু সেই রাতেই রাজাকার কমান্ডার আমিন উদ্দীন, ডেপুটি কমান্ডার দ্বীন মোহাম্মদের নেতৃত্বে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করা হয়। আমাকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয় এই বালিকা বিদ্যালয়ে, নির্যাতন কেন্দ্রে। অস্ত্র কই? জানতে চেয়ে জানালার সঙ্গে বেঁধে আমাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাত। শরীর রক্তাক্ত হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে আমি প্রায়ই মূর্ছা যেতাম। সাত দিন পরে আমাকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাবা জানতে পেরে রাজাকার কমান্ডার আমিন উদ্দীনের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চান। এরপর আমাকে কেশবপুর থানায় পাঠানো হয়। পরে নেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় জেলখানায়। দেশ স্বাধীন হলে আমি জেল থেকে বের হই। নির্যাতনের শিকার হওয়ার সেসব দিনের কথা মনে হলে এখনো আমি ব্যথা অনুভব করি। যন্ত্রণা টের পাই।’

উপজেলার বারুইহাটি গ্রামের কৃষ্ণ পদ দাস বলেন, ‘১৯৭১ সালের জুলাইয়ের গভীর রাত। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। আমি দরজা খুলে দেখি রাজাকারের দল। ওরা আমার চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। এরপর এই বিদ্যালয়ে তাদের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এখানে আমাকেসহ অন্তত ৩৭ জনকে সুন্দরী কাঠের লাঠি দিয়ে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় পেটানো হতো। মনে হতো, এর চেয়ে মরে গেলেই ভালো। ভয়ংকর নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়, ওরা আমার কাছে জানতে চাইত আর পেটাত। নির্যাতন সহ্য করেছি কিন্তু কখনো মুখ খুলিনি। প্রতিবার মারার একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম।’

ঘাঘা গ্রামের মসলেম উদ্দীন সরদার বলেন, ‘৪ আষাঢ় বাড়ি থেকে রাজাকারদের ডেপুটি কমান্ডার দ্বীন মোহাম্মদের নেতৃত্বে একদল রাজাকার রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমাকে তুলে নিয়ে আসে। রাজাকাররা আমার কাছে অস্ত্র কোথায় জানতে চাইত। এই বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশের একটি কক্ষে জানালার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিনে তিনবার করে পেটাত। শরীর থেকে রক্ত ঝরত। প্রতিবারই বেহুঁশ হয়ে পড়তাম। রাজাকার আবদুল খালেক, রফিকুজ্জামান আমার ওপর নির্যাতন চালাত। এখানে আট দিন থাকার পর আমাকে জামিন দেয়।’

বারুইহাটি গ্রামের শিবুপদ দাস বলেন, ‘আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ১৪ দিন পর রাজাকারদের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করা হয়। ছাড়া পেয়ে জানতে পারি, মঙ্গলকোট সেতুর মাথায় গুলি করে মানুষদের মেরে ফেলে বুড়িভদ্রা নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো।’

বড়েঙ্গা গ্রামের আবু তালেব গাজী, মঈন উদ্দীন গাজী ও বারুইহাটি গ্রামের গৌর চন্দ্র দাসও একাত্তরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার স্মৃতিচারণা করেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কেশবপুরের সাংসদ ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক। সভাপতিত্ব করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. কবীর হোসেন। বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তপন কুমার ঘোষ, মুক্তিযোদ্ধা অসিত মোদক, পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
এর আগে সন্ধ্যায় নির্যাতন কেন্দ্রের স্মৃতিস্তম্ভে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়।