সমুদ্রের ঘ্রাণ

>

একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠরা বাংলাদেশের চিরকালের নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সেসব রুদ্ধশ্বাস সমরে তাঁদের বীরোচিত আত্মত্যাগ আমাদের চিরন্তন প্রেরণা জোগায়।

বীরশ্রেষ্ঠ মো. রুহুল আমিন
বীরশ্রেষ্ঠ মো. রুহুল আমিন

হেমন্তের রৌদ্রহীন ম্লান দুপুরে একটা হালকা নীল ছায়া হয়ে আমি এলাম আমার জন্মভূমিতে। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল, পথের কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করে স্বাগত জানাল আমাকে। ছুঁয়ে দিলাম ফলবতী ধানের গোছা, নরম কালো মাটি। ‘আমি এসেছি, আমি এসেছি’ ফিসফিস করে বললাম। ‘এসেছি নিজের সঙ্গে নিজের আলাপটুকু সেরে নিতে, তোমাদের আলো-ছায়া-মায়াঘেরা স্মৃতির জগতে।’

যদি বেঁচে থাকতাম, এখন হয়তো অশীতিপর বয়স হতো আমার। দেহটা বয়সের ভারে হয়তো কুঁজো হয়ে যেত কিছুটা। অনেক প্রিয়জন হারানোর বেদনায় হয়তো নুয়ে পড়তাম। হয়তো জীবনের নানা সমস্যা-সংকটে থাকতাম পর্যুদস্ত। কে জানে! অবশ্য এই নশ্বর দুনিয়ায় বেঁচে না থাকায় দুঃখিত নই আমি। কারণ মৃত্যু তো আমাকে নিঃশেষ করতে পারেনি বরং নতুন জন্ম দিয়েছে। নতুন উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে। মৃত্যু নয়, বরং নিজের জন্মের কথা মনে পড়ছে আমার।

১৯৩৪ সাল হবে, দেশে তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বাঘপাঁচড়া গ্রামে আমি জন্ম নিলাম, আজহার পাটোয়ারী আর জোলেখা খাতুনের প্রথম সন্তান। মো. রুহুল আমিন। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাই। মাঠের মধ্যে ধুলা উড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলি, খেলতে গিয়ে পা মচকায়, চামড়া ছিলে যায়, নখ উপড়ে আসে, সেসব ব্যথা সহ্য করে আবার উঠে দাঁড়াই। ভরা বর্ষায় টইটম্বুর পুকুরের এই মাথা থেকে অন্য মাথায় দাপাদাপি করে সাঁতরে বেড়াই। আহা, জীবন বড় সুন্দর ছিল গো তখন।

প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে যাই আমিষ্যা হাইস্কুলে, তত দিনে দেশের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেছে। চাঁদ-তারা সাদা আর সবুজ নিশান উড়েছে আমাদের স্কুলে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। একদিন জেঠা বলে, ‘সকাল সকাল গিয়া চৌমুহনী কলেজের মাঠে খাড়া। পাকিস্তানের নেভি বলে লোক নিব। একবার গি ভর্তি হইতো ফারলে জীবনডা বদলায় যাইব। তুই উঁচা-লাম্বা আছোস, তর অই যাইব।’

জেঠার কথামতো আমি গিয়ে লাইন দিলাম। রেজিস্টি খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে এক সেপাই উর্দুতে জিজ্ঞেস করল, সাঁতার জানি কি না? জানি না মানে? ডাকাতিয়া নদীর এপার-ওপার চোখ বুজে পাড়ি দিতে পারি। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষায়ও টিকে গেলাম।

পাকিস্তান নৌবাহিনীতে জুনিয়র মেকানিক্যাল পদে চাকরি হলো আমার। প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো সোজা করাচির কাছে আরব সাগরের মধ্যকার মানোরো দ্বীপে। কোথায় আমার সোনাইমুড়ীর ডাকাতিয়া নদী, আর কোথায় এই আরব সাগর! নীল দরিয়ার আঁশটে গন্ধ আর আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে কাজ শিখি পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পিএনএস বাহাদুরে। আমার বস ক্যাপ্টেন জামশেদ মাঝে মাঝে আমার পিঠ চাপড়ে উর্দু আর ইংরেজি মিশিয়ে বলতেন, ‘তুম বহোত আচ্ছা আদমি হো। বহুতই জলদ সবকুছ শিখ রাহে হো। কিন্তু আফসোস, তুমি বাঙালি, ভাত খাওয়া বাঙালি। আধা হিন্দু, আধা মুসলিম!’

খুবই রাগ লাগত মনে মনে। কখনো ইচ্ছা হতো নাক বরাবর একটা ঘুষি লাগিয়ে দিই। বুঝিয়ে দিই ভেতো বাঙালির হাতের জোর কত! কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতাম। পিএনএস বাহাদুর থেকে আমাকে পাঠানো হলো পিএনএস কারসাজে। পিএনএস মানে, পাকিস্তান নেভি শিপ। এভাবে এক শিপ থেকে আরেক শিপে আমার পোস্টিং চলতে থাকল। পিএনএস বাবর, পিএনএস খাইবার, পিএনএস তুঘরিল। নৌবাহিনীতে আমার পদবি হলো আর্টিফিশার, সোজা বাংলায় জাহাজের ইঞ্জিনরুমের কারিগর বা মিস্ত্রি। যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতাম আমি। কে কী বলল, না বলল, পরের দিকে আর সেসব কিছুই গায়ে মাখতাম না।

প্রায় ১৫ বছর করাচির বিভিন্ন নৌঘাঁটিতে কাজ করার পর ১৯৬৮ সালে বদলি হয়ে এলাম চট্টগ্রামে পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে। আহ্ শান্তি। নিজের দেশের মাটিতে বা নিজের দেশের সাগরে ফিরে আসার। এর মধ্যে আমার গ্রামেরই মেয়ে জাকিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। আমাদের ১২ বছরের সংসার জীবনে দুই মেয়ে নুরজাহান, রেজিয়া আর ছেলে বাহারও জন্ম নিয়েছে। চট্টগ্রামে কোয়ার্টার পেয়ে স্ত্রী-সন্তানকে সোনাইমুড়ী থেকে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। ছোট ছেলে শওকত আলীর জন্ম হলো চট্টগ্রামে আসার পর। বড় সুখের কয়েকটা দিন কেটেছে তখন। সংসারের আঠালো মধুতে আটকে থাকার মজা উপভোগ করেছি। এদিকে দেশজুড়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে উনসত্তরের উত্তাল গণ-অভ্যুত্থান। চট্টগ্রামেও তার ধাক্কা এসে লেগেছে। প্রতিদিনই পুলিশের গুলিতে কারও না কারও মারা যাওয়ার খবর আসছে। নৌঘাঁটিতেও চাপা উত্তেজনা টের পাই। পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডাররা যেন খানিকটা অস্থির, কেমন চোখ সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি কি আর পাত্তা দেই ওসব? বরং ইঞ্জিনরুমে নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি। মন বলে, এদের সঙ্গে আর বেশি দিন নাই। বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে। মাওলানা ভাসানী তো আরও আগেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে দিয়েছেন।

দিনকাল সুবিধার না দেখে বাচ্চা-কাচ্চাসহ জাকিয়াকে সোনাইমুড়ী পাঠিয়ে দিলাম।

আমাদের জাহাজ বন্দর থেকে দূরে নোঙর করা ছিল। সব খবর পেতাম দেরিতে। ২৬ মার্চ ঢাকার গণহত্যার কথা শুনলাম। এরই মধ্যে আবার শুনলাম, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিরা নাকি আড়াই হাজার বাঙালি সৈনিককে মেরে ফেলেছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭ নম্বর জেটিতে ১১২ জনকে সোয়াত জাহাজে নিরস্ত্র অবস্থায় নিয়ে এসে মেরে ফেলা হয়েছে।

‘মারি বেকগুন লাশ হ্যাতারা দইজ্জাত ফালায় দিছে, স্যার।’ জাহাজের কুক মান্নান এভাবেই খবর দিত আমাকে। আমি মনে মনে পালানোর উপায় খুঁজছিলাম। শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসে সেই সুযোগ পেলাম। মনে হলো, বহুকাল পরে যেন মুক্তি পেলাম। একবার বাড়ি ঘুরে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে, বর্ডার পার হয়ে চলে গেলাম আগরতলা।

স্যালুট দিয়ে মেজর সফিউল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘স্যার, আমি পাকিস্তান নেভি থেকে আসছি। যুদ্ধ করতে চাই।’

মেজর সফিউল্লাহ একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন আমাকে। তারপর মাথা ঝাঁকালেন, বললেন, ‘আর্মস ট্রেনিং আছে? এইটা তো জলের না, স্থলের যুদ্ধ।’

ট্রেনিং নিতে বেশি দিন লাগল না। ২ নম্বর সেক্টরে শুকনায় অপারেশন করি, কিন্তু মাছের মতো আমার প্রাণ কাঁদে পানির জন্য, অকূল সাগরের নোনা গন্ধের জন্য, দরিয়ার নীল ঢেউয়ের জন্য। সুযোগ খুঁজে একদিন কমান্ডারের কাছে যাই, ‘স্যার, আমাদের নিজস্ব নেভি ফোর্স হবে না? স্বাধীন দেশের নৌবাহিনী বানাবেন না, স্যার?’

‘অপেক্ষা করো। আমাদেরও নেভি ফোর্স হবে।’ কমান্ডার গম্ভীর গলায় বলেন।

‘সত্যি স্যার? তাইলে আমার নামটা দিয়ে দিয়েন স্যার।’

‘দেব। ধৈর্য ধরো।’

অবশেষে একদিন ডাক আসে। সেপ্টেম্বর মাসে আমরা যারা পাকিস্তান নেভির সদস্য ছিলাম, যুদ্ধ করছিলাম বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে, তাদের সবাইকে একত্র করা হয় আগরতলায়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মণীন্দ্রনাথ সামন্তের সঙ্গে আমাদের কমান্ডারদেরও দেখতে পাই। ভালো লাগে। অবশেষে নিজেদের নৌবহর হচ্ছে আমাদের। জানতে পারি, যুদ্ধাবস্থায় নৌবাহিনী তৈরি হচ্ছে। আগরতলা থেকে কলকাতায় গিয়ে আমরা যোগ দিই সেই নৌবাহিনীতে।

সেই দিনটার কথা খুব মনে আছে আমার, যেদিন কলকাতা বন্দরে গার্ডেন রিচ ডকইয়ার্ডে ভারত সরকারের কাছ থেকে দুটো গানবোট পেলাম আমরা। একটা বোটের নাম পদ্মা, আরেকটা পলাশ। আমি হলাম আর্টিফিশার, নৌযানের মিস্ত্রি। একটু নাড়াচাড়া করেই বুঝতে পারলাম, বোট দুটোতে সুইডিশ ধরনের দুটি বাফোর গান আর ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের মার্কমাইন ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খারাপ না। এগুলো দিয়ে কায়দামতো আকাশের একটা-দুইটা শত্রু বিমান ঘায়েল করা সম্ভব। এমনকি দু-একটা জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়াও কঠিন হবে না।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে মো. রুহুল আমিনের বাস্তুভিটা। ছবিটি ১৯৮৫ সালে তোলা
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে মো. রুহুল আমিনের বাস্তুভিটা। ছবিটি ১৯৮৫ সালে তোলা

পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুমে আর্টিফিশার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সমুদ্রের ঘ্রাণ পেয়ে আমার রক্ত নেচে ওঠে, প্রতিটি রোমকূপের গোড়া যেন আনন্দে ঝমঝম করে ওঠে। বুকভরে নিশ্বাস নিই। স্বপ্ন দেখি, একদিন এই জাহাজ নিয়ে স্বাধীন দেশের সমুদ্রে যাব, প্রাণভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেব। ৬ ডিসেম্বর জাহাজে খবর আসে, মুক্তিযোদ্ধারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ফেলেছে।

‘বেক্গুন হাঞ্জাবি লেঙ্গুর তুলি হলাইছে। যেগ্গুনরে সামনে হাইছে মুক্তিরা, ধরি কচুকাটা কইচ্ছে। হ্যাতেগো দিন শ্যাষ।’ কুক মান্নান আনন্দিত কণ্ঠে খবর দেয়।

ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে, পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত খুলনা শিপইয়ার্ড দখলের অভিযানে বের হতে হবে। অপারেশনের কথা শুনে খুশি লাগে। ভারতীয় গানবোট পাভেলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের ‘পদ্মা’ আর ‘পলাশ’ ডিসেম্বরের ১০ তারিখে মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছায়। কিন্তু মোংলায় কোনো যুদ্ধ হলো না। পাকিস্তানের আর্মি আর নেভির যারা মোংলা দখল করেছিল, তারা কোনো রকম প্রতিরোধ না করেই আত্মসমর্পণ করল। কুক মান্নানের আনন্দ দেখে কে? চিৎকার করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল সে। ‘আঁরা জিতি গেছি, স্যার। জয় বাংলা। দেশ স্বাদিন অই গেছে। জয় বাংলা।’

কিন্তু আসলে আমাদের মিশন তো তখনো শেষ হয়নি। মোংলা পেছনে ফেলে গানবোট পাভেল সামনে আর পেছনে পদ্মা ও পলাশকে নিয়ে রূপসা নদীর ওপর দিয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডের পথে রওনা দিলাম আমরা। অগ্রহায়ণ মাসের ঝকঝকে নীল আকাশ। তাতে নরম তুলার মতো সাদা মেঘের ভেলা। খুব সুন্দর মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমাদের অল্পবয়সী ক্যাপ্টেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায়চৌধুরীকেও দেখলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজে ডেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘মিস্টার আমিন, ইউ আর ভেরি নিয়ার টু ইওর ইনডিপেনডেন্স! চিয়ার্স ম্যান!’

আমি একটু হাসলাম। আমাদের বোট খুলনা শিপইয়ার্ডে পৌঁছাতে খুব বেশি দেরি নেই। হঠাৎ মনটা কেমন করে উঠল। না জানি কী অপেক্ষা করে আছে সামনে। খালাসি শুক্কুরের গলা শুনলাম। ‘আকাশে দেখেন তো স্যার, অনেক ওপরে, তিনটা বিমান উড়তাছে, দেখছেন?’

রোদের জন্য সরাসরি তাকানো যাচ্ছিল না। ডান হাত কপালে রেখে রোদ এড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই। সত্যিই তো! আচ্ছা, এগুলো কি পাকিস্তানি বিমান? নজর রাখছে আমাদের ওপর? আরও ভালো করে তাকাই। নাহ্, বোঝা যায় না।

‘তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনকে খবর দাও।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক খালাসিকে বলি আমি।

একটু পরই দুরবিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায়চৌধুরী। বিমানগুলো চক্কর দিয়ে একেকবার মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আবার বেরিয়ে আসছে।

‘হয়তো ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স। আমাদের কাভার দিচ্ছে।’ রায়চৌধুরী অনুমান করেন।

অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মণীন্দ্রনাথ সামন্ত আছেন ভারতীয় গানবোট পাভেলে। পাভেল তখন পদ্মা আর পলাশকে পেছনে ফেলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। ওয়ারল্যাসে চিফকে সিগন্যাল পাঠানো হলো। উত্তর এল, ‘দৌজ আর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স। ডোন্ট ফায়ার।’

গুলি করতে নিষেধ করায় সবাই আবার যার যার কাজে ফিরে গেলাম আমরা, কিন্তু কেন যেন আমার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। আসলেই কি ওগুলো ভারতীয় বিমান, নাকি পাকিস্তানি বিমান আমাদের টার্গেট করল? কোথাও কোনো ভুল হয়নি তো? আল্লাহই জানেন! যাক, চিফ যা অর্ডার দিয়েছে তা-ই পালন করতে হবে আমাদের। এই ভেবে শুধু ইঞ্জিনরুমের দিকে পা বাড়িয়েছি কি বাড়াইনি, দেখি আচমকা সাঁই করে শূন্যে গোত্তা খেয়ে একটা বিমান নিচের দিকে নেমে এল। তারপর যেন চোখের পলকে দরিয়ার বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। বিমান থেকে ছোড়া প্রথম গোলা বিকট শব্দে এসে পড়ল সরাসরি পদ্মার ইঞ্জিনরুমের ওপর। সবার হতভম্ভ চোখের সামনে মুহূর্তেই তলিয়ে গেল দুর্ভাগা জাহাজটা। এবার গজবের মতো আকাশ থেকে নেমে আসে দ্বিতীয় গোলা। কিন্তু গোলাটা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় পলাশের আঘাতটা ততটা বিধ্বংসী হলো না।

‘লিভ দ্য শিপ! সেইলরস অ্যান্ড ক্রুজ, লিভ দ্য শিপ!’

চিৎকার করে আদেশ দেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায়চৌধুরী। এবার প্রচণ্ড রাগ হয় আমার। এটা কোনো অর্ডার হতে পারে না। আমাদের বোটে অস্ত্র দেওয়া হয়েছে কিসের জন্য? কেন আমরা শত্রুকে পাল্টা আঘাত করব না? বিমান নিচে নেমে এলেই তো ফায়ার করতে পারি আমরা, উড়িয়ে দিতে পারি শত্রুদের। তাহলে কিসের অপেক্ষা? কেন পিছু হটা? কেন ওদের চ্যালেঞ্জ না করে জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়া? না, মোটেই আমি মানতে পারি না। মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার।

‘ক্রু, ফায়ার! ফায়ার!’ শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে দিয়ে নৌবাহিনীর রীতিনীতি ভুলে পাল্টা চিৎকার করি আমি। পলাশকে টার্গেট থেকে সরিয়ে নিতে ইঞ্জিনরুমের দিকে দৌড়ে যাই। আর তখনই আরেক দফা নরক নেমে আসে পলাশের ওপর। একের পর এক গোলা পড়তে থাকে। আমি বুঝতে পারি, ক্রুরা কেউই ক্যাপ্টেনের আদেশ অমান্য করে গুলি ছোড়েনি, বরং জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি বিকল ইঞ্জিনরুমে। এই রকম হতবিহ্বল অবস্থায় যেন বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে বজ্রপাত হলো আমার শরীরের ডান পাশে, মনে হলো, ডান হাতটা কেউ যেন টেনে-ছিঁড়ে নিয়েছে। এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ডুবন্ত পলাশ থেকে ঝাঁপ দিলাম রূপসা নদীতে।

ছোটবেলা থেকেই সাঁতারে কেউ কখনো হারাতে পারেনি আমাকে, এবারও কীভাবে যে ধ্বংসযজ্ঞ পেছনে ফেলে এক হাতে সাঁতরে তীরে এলাম, জানি না। কয়েকজন মানুষকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন বুঝতে পারিনি, তারা আসলে মানুষ ছিল না। তীরে পৌঁছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মস্তিষ্ক হয়তো তখনো জেগে ছিল। আর ওই মানুষগুলো তখন বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আহত রক্তাক্ত এই আমাকে মেরে ফেলেছিল।

সত্যি বলছি, মরতে চাইনি আমি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখতে চেয়েছিলাম। রূপসার তীরে পড়ে থাকা আমার ডান হাতবিহীন ক্ষতবিক্ষত বিকৃত মৃতদেহটার পাশে বারবার ঘুরছিলাম আমি। তোমরা হয়তো জানো, বেশ কিছুদিন এভাবেই রূপসার তীরে পড়েছিল আমার মরদেহ। কেউ আমাকে দাফন করতে এগিয়ে আসেনি। কারণ, ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা শিপইয়ার্ড পাকিস্তানিদের দখলেই ছিল। ১৭ ডিসেম্বর খুলনা স্বাধীন হওয়ার পর আমার মৃতদেহ উদ্ধার করে রূপসার পাড়েই কবর দিলেন স্থানীয় লোকজন। মোংলা গেলে দেখতে পাবে, ওখানে আমার কবরে একটা স্মৃতিস্তম্ভও করা হয়েছে।

স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হয়তো সোনাইমুড়ীতে, এই বাঘপাঁচড়া গ্রামেই আমার কবর হতো। অবশ্য রূপসার তীরে মোংলার মাটিতে মিশে গিয়েও আমার কোনো ক্ষেদ নেই। এ-ও তো আমার দেশেরই মাটি।

আজ ৪৬ বছর পর নিজের বাড়ির লাগোয়া পানাভর্তি পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে বেশ দেখতে পাচ্ছি পাকা করা উঠানে একা একাই কুতকুত খেলছে এক কিশোরী। ও হচ্ছে বৃষ্টি, আমার নাতনি। ছোট ছেলে শওকতের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটার চেহারায় আমি শওকতের মায়ের ছবিটাই দেখতে পেলাম। সে রকম বড় বড় কালো চোখ, পাকা গমের মতো গায়ের রং।

ও বৃষ্টি, তুই কি কখনো মনে করিস তোর দাদাকে, যাকে কখনো দেখিসনি তুই! কোনো দিন তো দেখতেও পাবি না। ও, তোর স্কুলের বইয়ে আমার কথা লেখা আছে, বুঝি? প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর এই গ্রামে অনুষ্ঠান হয়। শহর থেকে নামীদামি মানুষজন আসে। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আলোচনা সভা হয়। সবাই তোর দাদার নাম করে। তুই তো দেখি সবই জানিস। বাহ্, এই তো দেখছি, আমার জন্মভিটায় একটা একতলা দালান, নৌবাহিনী থেকে বাংলা ১৩৯২ সনে এটা তোদের জন্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা-ও তো প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল! বর্ষার দিনে বাড়ির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে বুঝি? তোর মা রাবেয়ার অভিযোগ আছে সেটা নিয়ে, জানি। তোর বাবা—আমার ছোট ছেলে শওকত—যাকে দুই বছরের রেখে আমি চলে গেছিলাম, সে হয়েছে সরল-সিধা মানুষ। তেমন কিছু করে না। গ্রামের লোক বলে তার মাথায় নাকি সমস্যা আছে। কী আর করা যাবে বল, বৃষ্টি? তুই বরং বড় হয়ে তোর মায়ের দুঃখ দূর করিস। পড়ালেখা করিস তো ঠিকমতো?

বৃষ্টি এসে আমার হাত ধরে। একদম সেই জাকিয়ার মতো নরম স্পর্শ।

‘হ্যাঁ গো দাদা। পড়ি, লিখি আর আঁকি। একটা জিনিস চলো দেখাই তোমাকে। এই দেখো, বাড়ির দেয়ালে কত সুন্দর ফুল-পাতা এঁকেছি আমি। এইখানে আমার নাম লিখেছি। আর তোমার কথা মনে করে, ও দাদা, এই যে দেখো “জয় বাংলা” লিখেছি।’

আমি বৃষ্টির আঁকা ফুল-লতা-পাতায় হাত বুলাই, একবার জয় বাংলাকে ছুঁয়ে যাই। ও বৃষ্টি, তুই কিন্তু আমাকে মনে রাখিস। ও সবুজ মাঠ, হেমন্তের হলুদ ধানখেত, উড়াল দেওয়া শালিক, আমাকে ভুলো না কখনো।

মো. রুহুল আমিন

জন্ম

১ জুলাই ১৯৩৪

মৃত্যু

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

জন্মস্থান

বাঘপাঁচড়া, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী

যোদ্ধা

২ নম্বর সেক্টর ও নৌবাহিনী

যুদ্ধ

রূপসা নদীতে গানবোট পলাশে

পদবি

ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার

সমাধি

মোংলার রূপসা

নদীর পারে

মো. রুহুল আমিনের সমাধি