বীরশ্রেষ্ঠদের স্বপ্ন নবপ্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা

>

একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠরা বাংলাদেশের চিরকালের নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সেসব রুদ্ধশ্বাস সমরে তাঁদের বীরোচিত আত্মত্যাগ আমাদের চিরন্তন প্রেরণা জোগায়। সাত বীরশ্রেষ্ঠর ঘটনাবহুল জীবনকে নতুনভাবে দেখেছেন এই সময়ের সাত কথাসাহিত্যিক

বাংলা ভূমির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ এক অনন্য মাইলফলক। এর আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাঙালি বিভেদ ভুলে এক হতে শুরু করেছিল। পরে নেতৃত্বের জাদুকরি শক্তিতে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন এক ব্যতিক্রমী নেতা। আর বাংলা ভাষার এমন জাদু যে তাঁর গুণে সব বিভাজন ভুলে এক জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এ দেশের জনমানুষ। একাত্তরে ‘এক নেতা এক দেশ, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ’—এই ছিল তাঁর পরিচয়। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’—এই তাঁর অহংকৃত ঘোষণা। সেদিন এক মন্ত্রে সবাই ছিল উজ্জীবিত—‘জয় বাংলা’। বাংলার জয় সেদিন হয়েছে। আবির্ভূত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

দুই

বাংলাদেশ একটি স্বপ্নের নাম। বহু মানুষের স্বপ্ন–সাধের দেশ এই বাংলাদেশ।

যদি প্রশ্ন ওঠে কার স্বপ্ন? কত মানুষের স্বপ্ন? তবে হাতের কাছে কাজ চালানোর মতো উত্তর মিলে যায়, সেই সব মানুষের, যাঁরা এর জন্য আন্দোলন চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

একটু গুছিয়ে বলা যায়, সেই বায়ান্ন থেকে যে ভাষার লড়াই, চুয়ান্নতে দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতির প্রত্যাখ্যান, বাষট্টির গণতান্ত্রিক শিক্ষার আন্দোলন, ছেষট্টির স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আটষট্টির সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের সংগ্রাম, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনী রায়, একাত্তরের অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধ—এসবের ধারাবাহিকতায় এসেছে স্বাধীনতা, ঘটেছে স্বপ্নসাধের পূরণ। বাংলাদেশ অযুত মানুষের দান। কিংবা বলা যায়, অসংখ্যের এক স্বপ্নময় নির্মাণ।

এই অসংখ্য অযুতজন কারা? কতজন?

ইতিহাসের যে চুম্বক-ছক এঁকেছি, কেবল কি এই সব ঐতিহাসিক মাইলফলকের নির্মাতা অনুসারী ও নেতাদের অবদান এই স্বাধীনতা? ইদানীং যেভাবে উচ্চারিত হয়—একি শুধু সেই একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় সৃষ্টি? বা কেবল কি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের, সীমাভুক্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী লড়াকু মানুষের ধারাবাহিক যৌথ অর্জনের ফল?

প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের মুখোমুখি করে, আমাদের অব্যক্ত আবেগকে স্বপ্নের স্ফূর্তি দেয়। আমরা বলি, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই বাংলার স্বাধীনতা এসেছে। পিঠাপিঠি অনুক্ত আবেগ হলো—এক আকাশ স্বপ্নের বিনিময়ে মিলেছে এমন স্বাধীনতা।

এ কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী রাজনীতিক, লড়াকু কর্মী, সচেতন নাগরিকের আরাধ্য ছিল না। ছাত্র-তরুণ, কৃষক-শ্রমিক, গৃহস্থ-গৃহহীন, প্রবীণ-নবীন, নারী-কিশোর—কেউই এই স্বপ্নের দোলায় ও স্বাধীন স্বদেশের সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এর প্রেরণায় উজ্জীবিত না হয়ে পারেননি।

তিন

ইতিহাসের যে ঘটনা কিংবদন্তিকেও হার মানায়, সেটা গর্ব করে বলার বিষয়, নিছক তথ্যের চেয়ে অনেক বড়। কিংবদন্তির বাড়া। সে অর্থে গল্প। বাঙালি চিরকালের ঘরকুনো, মাটি আঁকড়ে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছে বহুকাল। এতকাল ধরে যে সেটাই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয়।

একাত্তর সেই দুর্নামের প্রত্যুত্তর। যোগ্য জবাব। একাত্তর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী বছর। সেদিন ভেতো বাঙালি বীর বাঙালিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। কোন্দলপ্রবণ জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশাল শক্তিতে জেগে উঠেছিল সেদিন। বাঙালি জাতি হিসেবে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার জন্য লড়েছে পূর্ব পাকিস্তান। জয়ী হলে তার পরিচয় হবে বাংলাদেশ।

অবশেষে অসংখ্য হত্যার বিভীষিকা, অগণিত লাশের ফরিয়াদ, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, অশ্রু—সবকিছুর জবাব ১৬ ডিসেম্বর। ভেঙে গেল পাকিস্তান। অসার খোলস হয়ে পড়ে রইল বিজয়ীর পদতলে। গ্লানি ঝেড়ে যে মাথা তুলে দাঁড়াল, সে বাংলাদেশ। সদ্যোজাত দেশ। যুদ্ধে বিধ্বস্ত কিন্তু বিজয়ীর হাসিটি তারই মুখে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই হাসির পেছনে অশ্রু যেমন আছে, তেমনি আছে মৃত্যু ও ত্যাগের মহিমা। সেই মহিমান্বিত চিত্রপটে জ্বলজ্বল করছে শত শহীদের নাম। বহুমূল্য মণিমুক্তার মতো ভাস্বর বীরশ্রেষ্ঠদের অবদান।

চার

আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ আছেন সাতজন। তাঁরা সবাই একাত্তরে রণাঙ্গনের শহীদ। ছয়জন এই বাংলাদেশে হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, একজন বৈমানিক পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে শহীদ হয়েছেন পশ্চিম রণাঙ্গনে। সব মুক্তিযোদ্ধাই প্রাণ বাজি রেখে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁদেরও অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন সেদিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর বাঙালির অকুতোভয় আত্মত্যাগের যে মহিমা একাত্তরে প্রকাশ পেয়েছিল, বীরশ্রেষ্ঠ সাতজন যেন তারই মহিমান্বিত প্রতীক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহিমান্বিত প্রতীকগুলো ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, তাঁরা পাঠ্যপুস্তকে গুরুত্ব পাচ্ছেন, কিছু কিছু স্থাপনায় তাঁদের নামাঙ্কিত হচ্ছে, জন্ম-মৃত্যুর দিনে কিংবা জাতীয় দিবসে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। তবে যাঁরা দেশের জন্য ইতিহাসের গৌরবলগ্নে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় নিজেদের স্বীকৃতির তোয়াক্কা করেননি। তাঁদের ভাবনায় ছিল শত্রু নিধন, দেশকে দখলমুক্ত করে স্বাধীন করা। তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, বিনিময়ে দেশও হয়েছে স্বাধীন।

স্বাধীন দেশের কাছে কী প্রত্যাশা ছিল বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী দেশবাসীর? তার কিছু প্রকাশ ঘটেছিল বাহাত্তরের সংবিধানে। কিন্তু পঁচাত্তরের প্রত্যাঘাতের পর প্রথমে সংবিধানই স্থগিত হয়ে গেল, মানুষের মৌলিক অধিকার হলো খর্ব, তারপর সংবিধান থেকে বাদ পড়ল সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা। এবার মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার সহযোগিতায় পুনর্বাসিত হলো একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা, ধীরে ধীরে তারা শক্তি সঞ্চয় করল, তার ফলে সমাজের অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ নষ্ট হতে থাকল। আজ নানামুখী উন্নয়নের মধ্যেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গেছি। হ্যাঁ, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে অনেকখানি, প্রায় ১ হাজার ৬০০ ডলারে পৌঁছেছে, গড় আয়ু ৭০ ছাড়িয়েছে, প্রাথমিকে ভর্তি প্রায় শতভাগ হচ্ছে, মেয়েদের ক্ষমতায়নও চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া পদ্মা সেতু, উড়ালসড়ক, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি মিলিয়ে অবকাঠামোর উন্নতিও বুক ফুলিয়ে বলার মতো। কিন্তু এত উন্নতির মধ্যেও দেশ যেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গেছে। বাঙালির উদার মানবতাবাদী সমাজে সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি ধর্মীয় কট্টরপন্থা ও ইসলামি জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, সমাজে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, সন্ত্রাস ও সহিংসতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে, গণতন্ত্র ও সুশাসন কথার কথায় পর্যবসিত হয়েছে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়ে চলেছে। নিশ্চয় বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ কারণে প্রাণ দেননি। সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ যে স্বপ্নে একটি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল, দেশ আজ অনেক দিন সেই পথে চলছে না। উন্নতি হচ্ছে বটে, কিন্তু সে কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফসল? বীরশ্রেষ্ঠদের ত্যাগের মহিমা কি প্রকাশ পাচ্ছে এ দেশে?

পাঁচ

দেশ জয়ী হয়েছে, বিপুল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকাও ওড়ে মাথা উঁচিয়ে, বীরশ্রেষ্ঠ আর ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিও থাকে অম্লান। একাত্তরে ঘটেছিল মানবের জাগরণ। কিন্তু একসময় কোন দিক থেকে ধেয়ে এল ভাটার টান, বুঝে ওঠার আগেই আসে পঁচাত্তরের কালরাত। ক্রমে ম্লান হতে থাকে একাত্তরে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো নির্ভীক জাতির ভাবমূর্তি। সেদিনের সেই মহান উত্থান অতীতের স্মৃতিতে বিবর্ণ হতে থাকে। ধর্মান্ধতা ছাপিয়ে ওঠে বাঙালির হাজার বছরের উদার মানবতার ধারাকে, জন্ম নেয় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস।

আজ বিজয় দিবসে একাত্তরের সব অর্জন মস্ত বড় প্রশ্ন হয়ে পথরোধ করে দাঁড়ায়—মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতি ও ব্যক্তিজীবনে কতটা টেকসই হলো? জাতির এই গৌরব যেন চিত্রপট হয়ে পেছনে সরে যাচ্ছে ক্রমেই।

ছয়

এটা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় অর্ধশত বছর পরে আমরা নতুন কালান্তরে এসে উপনীত হয়েছি। পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির নানা উৎকর্ষে মানুষের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছে। এ-ও মানুষের মুক্তির অভিযাত্রায় নানামাত্রিক ভূমিকা পালন করছে। আমরা আশা ও স্বপ্ন নিয়ে লক্ষ করছি, একালের তরুণসমাজ নতুন ভাবনায় জেগে উঠছে। তারা পৃথিবীকে, এ কালকে এবং নিজের দেশ ও ভবিষ্যৎকে নিয়ে নতুন স্বপ্নের নতুন সম্ভাবনার কথা বলছে। সেসব কথা শোনা যাচ্ছে, তাদের সফলতার অনেক দৃষ্টান্তও দেখা যাচ্ছে।

বীরশ্রেষ্ঠরা একটি দেশের জন্ম দিয়েছেন, তাঁরা আমাদের কালের ও বাংলাদেশের চিরকালের নায়ক। আর নতুন কালের নায়কদের পদধ্বনিও আমরা শুনতে পাচ্ছি।

আর সেখানেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা, সেখানেই আমাদের আশা ও স্বপ্নের বসতি। বাংলাদেশ তার নবপ্রজন্মের হাত ধরে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে।