মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের নেতৃত্বে কর কর্মকর্তা

দিপঙ্কর চন্দ্র সরকার
দিপঙ্কর চন্দ্র সরকার

মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের প্রধান সরকারের একজন সহকারী কর কমিশনার। অর্থের বিনিময়ে সহযোগীদের নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করেন তিনি। কয়েক বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁস করে এই চক্রটি কয়েক কোটি টাকা আয় করেছে।

এই সহকারী কর কমিশনারের নাম দিপঙ্কর চন্দ্র সরকার। সরকারি চাকরির আড়ালেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রটি গড়ে তুলেছেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁর অফিস থেকেই জব্দ করেছেন ১ কোটি ৭ লাখ টাকার চেক। আর তাঁর সহযোগীদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে আরও ৩ কোটি ৫০ লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক।

চক্রটি এ বছরই কমপক্ষে ৬০ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের কাছ থেকে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক নেয়। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ওই সব চেকসহ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে আদালতে ১৬৪ ধারায় একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পলাতক বেশি

এ পর্যন্ত দিপঙ্করসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চক্রের প্রধান দিপঙ্কর গ্রেপ্তার হওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আসেন। অন্যরা ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে জামিনে মুক্ত হন।

এ পর্যন্ত মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের পাঁচজন আইনের আওতায় এসেছেন। গ্রেপ্তার হলেও তাঁরা এখন জামিনে আছেন। তাঁরা হলেন সামছুর রশীদ ওরফে দিপু (চিকিৎসক), সোলায়মান হোসেন ওরফে মেহেদি (চিকিৎসক), একরামুল ইসলাম ওরফে বাবু (বেকার যুবক), রাশেদুজ্জামান ওরফে রিপন (ছাত্র) এবং সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে তিন্নী (রিপনের আত্মীয়)।

মামলার এজাহারে নাম আসা ১৫ জনই পলাতক। তাঁরা হলেন সাবিনার ভাই কলেজশিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন, সুজন ওরফে রাজা বাবু (পঞ্চগড়ের একটি কলেজের শিক্ষক), ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থী সাইফুল আলম ওরফে বাদশা ও ফয়সাল আহমেদ ওরফে রাসেল, চিকিৎসক আসাদ ও অনিক, মোহাম্মদ লিটন (শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারের একজন মালিক) এবং তানজির হাসান ওরফে প্রেমেল (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের ছাত্র)। এ ছাড়া আবু তালেব, এস কে নূরুল ইসলাম, রোকোনুজ্জামান, সামিউল সোহান, রিয়াদ রহমান, পারভেজ হোসেন ও কামরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

র‍্যাব-১০-এর কর্মকর্তা মুহম্মদ মহিউদ্দীন ফারুকি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে।

চেক ও প্রশ্ন উদ্ধার

এ বছরের ৬ অক্টোবর সকাল ১০টায় ছিল ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা। ওই দিন সকাল আটটায় র‍্যাব-৩ রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট থেকে দিপঙ্করকে গ্রেপ্তার করে। র‍্যাব দিপঙ্করের মুঠোফোন জব্দ করে। পরীক্ষা করে র‍্যাব দেখে, মুঠোফোন থেকে দিপঙ্কর তাঁর সহযোগী একরামুল ইসলামকে মেডিকেলের প্রশ্ন বিতরণ সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন।

মুঠোফোনের সূত্র ধরে র‍্যাব যাত্রাবাড়ী থেকে একরামুলকে গ্রেপ্তার করে। একরামুলের কম্পিউটারে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র পায়।

ওই দিন র‍্যাব দিপঙ্করকে নিয়ে সেগুনবাগিচার কর অঞ্চল-৬-এ যায়। রাজস্ব কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দিপঙ্করের অফিস থেকে ১ কোটি ৭ লাখ টাকার ১৪টি চেক, প্রশ্নপত্র, ১৬ জন পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্রের ফটোকপি উদ্ধার করে।

পরদিন ভোরবেলা র‍্যাব-১০ রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় সাবিনা ইয়াসমিনের বাসায় যায় এবং ওই বাসা থেকে ৩৫টি চেক, প্রশ্নপত্র, শিক্ষার্থীদের ১১টি সনদ উদ্ধার করে। এরপর মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে সাবিনার আত্মীয় রাসেদুজ্জামানের বাসা থেকে প্রশ্নপত্র ও তিনটি চেক উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে আদাবরে একটি বিলাসবহুল ভবনে সামছুর রশীদের বাসায় যায়। র‍্যাব তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের তিনটি চেক, ১০ পরীক্ষার্থীর মূল সনদ, পাঁচজন অভিভাবকের মূল জাতীয় পরিচয়পত্র ও প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে।

এর পরদিন, অর্থাৎ ৮ অক্টোবর র‍্যাব গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক সোলায়মান হোসেনের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পাঁচটি চেক, প্রশ্নপত্র, নয়জন শিক্ষার্থীর মূল সনদ এবং পাঁচজন অভিভাবকের মূল জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করে।

র‍্যাব তাঁদের প্রত্যেককেই গ্রেপ্তার করে। র‍্যাব বাদী হয়ে পাবলিক পরীক্ষা আইনে রাজধানীর কলাবাগান ও হাজারীবাগ থানায় যথাক্রমে ৭ ও ৮ অক্টোবর দুটি পৃথক মামলা করে।

তবে এ সম্পর্কে কিছু জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক এম এ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার দিন কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল কি না বা প্রশ্নপত্র উদ্ধার করেছিল কি না, তা র‍্যাব তাদের জানায়নি।

মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁসে লেনদেন
মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁসে লেনদেন


কর কর্মকর্তার কারবার

‘দিপঙ্কর পারে না এমন কোনো কাজ নেই’—সহকারী কর কমিশনার দিপঙ্কর সম্পর্কে এমনই মন্তব্য তাঁরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা দিপঙ্কর ২০০৬ সালে কর পরিদর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর ১০ বছর পর ২০১৬ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর অঞ্চল-৭-এর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিপঙ্কর ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে জানে। ওকে ঢাকার বাইরে পদায়ন করা কঠিন।’ প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত দিপঙ্কর এক মাস ছিলেন চট্টগ্রামে আর দেড় মাস ছিলেন ফরিদপুরে। বাকি সময় রাজধানীতে।

মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে দিপঙ্করের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া র‍্যাব-৩-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি দেওয়ার সূত্রেই দিপঙ্করের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর বেকার যুবক একরামুল ইসলামের সম্পর্ক তৈরি হয়। একরামুলকে দিয়ে দুটি ই–মেইল খোলান। তাঁকে দিয়ে প্রশ্ন সংগ্রহ ও প্রশ্ন বিতরণ করান। আদালতে দেওয়া জব্দ তালিকায় সেই ই–মেইল ও ই–মেইলে আসা প্রশ্নপত্র আছে।

এ ব্যাপারে দিপঙ্কর প্রথম আলোকে বলেন, একজন ভালো কর আদায়কারী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। এ জন্য প্রতিবছর তাঁকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। পেশাগত কাজের কারণে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে ফাঁসিয়েছে। প্রশ্নপত্র ও চেক উদ্ধার সাজানো নাটক। দিপঙ্কর জানান, তিনি ছাত্রজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। পরে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য হয়েছিলেন।

কে কী অবস্থায়

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১১ অক্টোবর দিপঙ্করকে সাময়িক বহিষ্কার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের তদন্তেও দিপঙ্করের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে র‍্যাব ধরে নিয়ে যাওয়ার পরপরই সোলায়মানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। চিকিৎসক সামছুর রশীদও আর আগের জায়গায় কাজ করেন না। তাঁর নতুন কর্মস্থলে গেলে সামছুর রশীদ দাবি করেন, কেউ কারসাজি করে তাঁকে এ ঘটনায় জড়িয়েছে।

মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে রাসেদুজ্জামানের বাসায় গিয়ে জানা যায়, তিনি ও তাঁর সহভাড়াটেরা বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর একজন সহভাড়াটে অমিতাভ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রাসেদুজ্জামানের কাছ থেকে তিনি কোনো প্রশ্নপত্র পাননি। তবে তিনি সিলেট ডেন্টালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। র‍্যাব তাঁর উপস্থিতিতেই প্রশ্নপত্র উদ্ধার করেছিল।

ব্যাংককে নির্দেশ

পুলিশ, র‍্যাব ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগদ টাকা আদায়ের জন্য চক্রটি চেক, জাতীয় পরিচয়পত্র বা শিক্ষার্থীদের মূল সনদ রেখে দিত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নগদ টাকা দিয়ে সেসব ফেরত নেওয়ার অলিখিত চুক্তি ছিল।

জব্দ করা ৬০টি চেকের ১৪টি পাওয়া গেছে দিপঙ্করের অফিস থেকে। প্রথম আলো দিপঙ্করকে দেওয়া চেকের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। চেকের সঙ্গে দেওয়া মেডিকেল পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও মূল সনদ জমা দেওয়া চারজন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও প্রথম আলো কথা বলেছে। তাদের কেউ নিজ হাতে কাউকে চেক দেয়নি। তাদের বাবা, মামা বা পরিবারের অন্য সদস্য এটা করেছিলেন। তাদের একজন মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

গত ৫ নভেম্বর কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক আলহাজ উদ্দীন দিপঙ্করের কাছ থেকে পাওয়া চেকগুলোর মালিকদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা যেন ব্যাংকগুলো দেয়, তার জন্য আদালতে আবেদন করেন। এরপর ১৩ নভেম্বর আদালত ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের তথ্য দিতে নির্দেশ দেন। অপর মামলায় জব্দ হওয়া ৪৬টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করবে র‍্যাব-১০। মামলার তদারক কর্মকর্তা র‍্যাব-১০-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহম্মদ মহিউদ্দীন ফারুকি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের চেক পাওয়া গেছে তাঁদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

পুরো বিষয়টি শোনার পর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, অর্থ নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। এক শ্রেণির অভিভাবকের বিশ্বাস, অর্থ ঢাললে প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবেই। আবার প্রশ্নপত্র ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই সৎ, এটা ভাবা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষায় মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না করলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতেই থাকবে। আর মানুষ বঞ্চিত হবে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে।’