২৯ 'ঝুঁকিপূর্ণ' ভবনে পাঠদান

পীরগাছার পশ্চিমদেবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো
পীরগাছার পশ্চিমদেবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো

পাশাপাশি দুটি ভবন। একটি তিন কক্ষের পাকা ভবন। অন্যটি পাঁচ কক্ষের আধা পাকা ভবন। এর দেয়ালে দেয়ালে ফাটল। ছাউনির টিন জরাজীর্ণ, ছিদ্রে ভরা। আধা পাকা এই ভবন ১৯৪২ সালে নির্মিত। উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তর ভবনটিকে অনেক আগেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকেরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই পাঠদান করছেন। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নেকমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি।

 শুধু এই বিদ্যালয়ই নয়, উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তর এই উপজেলায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ২৯টি চিহ্নিত করেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। যেকোনো সময় প্রাণহানির মতো বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭৮টি। এর মধ্যে ২৯টি বিদ্যালয়ের আধা পাকা ও পাকা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। বিদ্যালয়গুলো হলো নাছুমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঙদারপাড়া, কালিগঞ্জ, নেকমামুদ, মহিষমুড়ি, ইটাকুমারী, ধলখানা, ছাওলা, কৈকুড়ি, মকরমপুর, রহমতচর, চৌধুরাণী ১ নম্বর, বালারদীঘি, কান্দি, তাম্বুলপুর, পশ্চিমদেবু, সুখানপুকুর, অন্নদানগর, তালুক ইশাদ, দুধিয়াবাড়ী, জামিরজান, চৌধুরাণী ২ নম্বর, পঞ্চানন, পশ্চিম ছাওলা আদর্শ, টেপচার বন্দর, পূর্ব শিবদেবচর, গোবড়াপাড়া, ব্রাক্ষ¥নীকুন্ডা ও চণ্ডীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

 জানতে চাইলে নেকমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উম্মে হাবিবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে আটজন শিক্ষকের মধ্যে আছেন সাতজন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০। কার্যালয়সহ কক্ষ দরকার সাতটি। কিন্তু নিরাপদে ক্লাস নেওয়া যায় এমন পাকা কক্ষ আছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে দুটি কক্ষে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চলে। অন্যটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। টিনশেড ভবনের পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ কক্ষের মধ্যে দুটিতে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হয়। অন্য তিন কক্ষে ঢোকাই মুশকিল। কক্ষসংকটের কারণে শিশু ও প্রথম শ্রেণির ক্লাস নিতে হয় বারান্দায়। আট বছর ধরে এই সমস্যা পোহাচ্ছি। কোনো সমাধান হয়নি।’

নাছুমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিনুর ইসলাম বলেন, এই বিদ্যালয়ের ভবনসংখ্যা চারটি। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি পাকা ভবনের চারটি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও সেখানে ক্লাস নেওয়া হতো। কিন্তু মাস পাঁচেক আগে ভূমিকম্পে পুরো ভবনে ফাটল ধরায় এখন আর পাঠদান করা হয় না। এ কারণে শ্রেণিকক্ষের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিক্ষার্থীদের একই কক্ষে বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসিয়ে পড়ানো হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে চারটি কক্ষ নির্মাণ করা দরকার। বিদ্যালয় মাঠটি অনেক নিচু হওয়ায় বর্ষাকালে পানি জমে থাকে। এ সময়ে অন্তত ছয় মাস শরীরচর্চা ও খেলাধুলা বন্ধ থাকে। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক ১৭ জন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭২।

পশ্চিমদেবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দুটি। একটি পাকা, অন্যটি আধা পাকা টিনশেড। টিনশেড ভবনের চারটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ। কক্ষগুলোর দরজা-জানালা নেই। শিক্ষক পাঁচজন। শিক্ষার্থী ১৮৬।

প্রধান শিক্ষক নাহিদা কবীর বলেন, কক্ষসংকটের কারণে দুপুর ১২টা থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস শুরু করতে হয়। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। কক্ষের সংকট সমাধানে টিনশেড ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা ছাড়া উপায় নেই।

তাম্বুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান চলে এক শিফটে। সেখানে শিক্ষক আছেন ১১ জনের মধ্যে আটজন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১৫। ওই বিদ্যালয়ে টিনশেড ভবন একটি ও একটি পাকা ভবন। এর মধ্যে টিনশেডের চার কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকিপূর্ণ কক্ষগুলোর পাকা দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ছাউনির টিন একেবারেই জরাজীর্ণ। সংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ আধা পাকা টিনশেড কক্ষে পাঠদান করা হয়।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কক্ষের সংকট রয়েছে। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ক্লাস নিতে হচ্ছে। ছাউনির টিন ফুটা হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে তিনটি কক্ষে ক্লাস নেওয়া যায় না। তা ছাড়া বিদ্যালয়ে রয়েছে বেঞ্চসংকট।’

সুখানপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৬৫ সালে পাঁচ কক্ষের আধা পাকা একটি টিনশেড ভবন নির্মাণ করা হয়। এটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। একটি কক্ষ ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। অন্য চার কক্ষের একটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনটিতে চলছে নিয়মিত ক্লাস। পাকা একটি ভবনে কক্ষ রয়েছে দুটি। এই দুই কক্ষেও পাঠদান করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০। শিক্ষক পাঁচজন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পীযূষ কান্তি বর্মণ বলেন, টিনশেড ভবনের কক্ষগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ক্লাস নিতে হচ্ছে।

 ওই ২৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর রয়েছে। কিন্তু কক্ষসংকটের কারণে বছরের পর বছর ধরে প্রজেক্টরগুলো আলমারি কিংবা বাক্সবন্দী করে রাখা আছে।

নাছুমামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘২০১২ সালে বিদ্যালয়ে একটি ল্যাপটপ এবং ২০১৩ সালে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর পেয়েছি। কক্ষসংকটের কারণে এসব বছরের পর বছর বাক্সবন্দী। সরকার ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর দিয়েছে, কিন্তু এগুলো রাখার জন্য মাল্টিমিডিয়া কক্ষ নেই।’

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান বলেন, ওই সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ কক্ষগুলোর বিষয়ে একাধিকবার সভায় আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ নভেম্বর আবারও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে আগামী জানুয়ারি মাসের পর প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ভবন নির্মাণের বরাদ্দ আসে ওপর থেকে। আমাদের করার কিছু নেই। তবে আমিও জানি ওই বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের জন্য চরম কক্ষসংকট রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ১৪টি বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করার জন্য গত মার্চে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

উপজেলা প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ওই সব বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে ক্লাস নেওয়ায় যেকোনো সময় প্রাণহানির মতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ আধা পাকা ও পাকা ভবনগুলো নিলামের জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে একাধিক চিঠি দিয়েছি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘদিনেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। বাধ্য হয়ে গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত উপজেলা মাসিক সভায় বিষয়টি আলোচনায় তুলেছিলাম।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাউজুল কবীর বলেন, ‘যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কনডেমড ঘোষণা চেয়ে আমাদের জানাতে হবে। উপজেলা কনডেমড কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি এবং সদস্যসচিব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ অন্য সদস্যরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে তা দেখব। এরপর শিক্ষা প্রকৌশল কর্মকর্তারা সরেজমিনে দেখেশুনে জানালে তবেই সে ভবন উপজেলা কনডেমড কমিটির সভায় আলোচনা সাপেক্ষে কনডেমড ঘোষণা করে নিলামের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু ভবন ভাঙার পর কিছুতেই যেন পাঠদান ব্যাহত না হয়, সেটি আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা অনুসরণ করেই ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থা নেব।’