স্বস্তি আসছে না জনমনে

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

প্রথম আলো: বছরজুড়ে মানবাধিকারের চিত্রটি কেমন ছিল বলে মনে করেন?

সুলতানা কামাল: মানবাধিকার চিত্র কেমন ছিল, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে হলে মানবাধিকারের সূত্রগুলো একটু মনে করতে হবে। সহজ ভাষায় মানবাধিকার যেখানে বিরাজ করবে, সেখানে মানুষ যে অবস্থানে থাকুক না কেন তিনি নিজেকে একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ভাবতে পারবেন। তাঁর অধিকারের কোনো লঙ্ঘন ঘটলে তিনি ন্যায়বিচার আশা করতে পারেন এবং অবশ্যই তিনি প্রতিনিয়ত কোনো শঙ্কার মধ্যে বাস করতে বাধ্য হবেন না। ২০১৭ সালের শেষে এসে উপরোক্ত মাপকাঠিতে বিচার করতে হলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতেই হয়, নির্বিচারভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা যে হারে ঘটে চলেছে—দলবদ্ধ ধর্ষণ, একই বাড়িতে একাধিক নারীকে ধর্ষণ, শিশুদের প্রকাশ্যে দিবালোকে পিটিয়ে বা ভয়ংকর উপায়ে হত্যা করা, প্রায় বছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা—এসব ঘটনার কোনো বিচার না হওয়া বা বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা—এসব কিছুই মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এরপরও মানুষের হারিয়ে যাওয়ার যে ঘটনাগুলোকে আমরা গুম বলে চিহ্নিত করছি—যদিও সরকারের এ সংজ্ঞা মেনে নিতে আপত্তি আছে—সেসবের কথা যদি উল্লেখ করতে হয়, তাহলে বলতেই হয় আমাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে। মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হুমকি অথবা তাঁদের মেরে ফেলার ঘটনার কোনো বিচার না হওয়া মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এসব ঘটনার কোনো সুরাহা না হওয়ায় মানুষ একটা শঙ্কার মধ্যে বসবাস করছে। সেটা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে রোহিঙ্গাদের যেভাবে সহয়তা করা হয়েছে, সেটা জাতি হিসেবে আমাদের স্বস্তির জায়গায় এনে দিয়েছে।

প্রথম আলো: মানবাধিকার সংগঠনগুলো কি যথেষ্ট সোচ্চার ভূমিকা রাখতে পারছে?

সুলতানা কামাল: মানবাধিকার সংগঠনের বেশির ভাগই তো বেসরকারি সংগঠন। বেসরকারি সংগঠনগুলোকে তো একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর যে বিষয়গুলো আছে, সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয় এবং প্রায়ই দেখা যায় যে সরকারের মনঃপূত হচ্ছে না এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে কিংবা এমন কোনো বক্তব্য দিলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে কিন্তু সেটার ফল ভোগ করতে হয়। এর ফলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও চেষ্টা করেন অসন্তুষ্ট না করে যতখানি কাজ করা যায় ততটুকুই করার। সেখানে তো যথেষ্ট সোচ্চার হওয়ার সুযোগটা সীমিত। সে জন্যই বাস্তবতা হচ্ছে যে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর যতটা সোচ্চার হওয়া দরকার সব সময়—আমি বলব না যে কোনো সময়ই পারে না, বা কোনো সংগঠনই পারে না—সব সময় সব সংগঠন সে রকম ভূমিকা নিতে পারে না।

প্রথম আলো: অন্য দেশের সংস্থাগুলো কীভাবে কাজ করে?

সুলতানা কামাল: অন্যান্য দেশে যেটা হয়, মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে অনেক স্বাধীনভাবে একটা কাজ করতে দেওয়ার একটা নীতি থাকে। আমাদের দেশে কিন্তু নীতিগতভাবেই সেটা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। তারপরও আমি বলব, মানবাধিকারের বিষয়গুলোর কথাবার্তা বাংলাদেশে যথেষ্ট হয়। মিডিয়া এখানে যথেষ্ট সোচ্চার আছে কিংবা মিডিয়া যথেষ্ট সহযোগিতা করে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে।

প্রথম আলো: নিরাপত্তার দিক থেকে জনমনে কতটা স্বস্তি এসেছে বলে মনে করেন?

সুলতানা কামাল: স্বস্তির জায়গাটায় সবচেয়ে বড় ফাঁক রয়ে গেছে। অনেক সময় অনেক পদক্ষেপ হয়তো রাষ্ট্র নিচ্ছে। কিন্তু এমনভাবে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে, যেখানে জনগণ মনে করতে পারে না যে আমার অধিকারের লঙ্ঘন ঘটলেই রাষ্ট্র সেখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। সেই আস্থাটা মানুষকে কিন্তু এখনো রাষ্ট্র দিতে পারছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সুরাহা হচ্ছে। কিন্তু সেটা খুব নির্বাচিত পর্যায়ে। ধরেই নেওয়া যায় যে এদের ওপর যদি মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটে, তাহলে সুরাহা পাবে। এর বাইরে যারা আছে, বলয়ের বাইরে যারা আছে, তারা সুরাহাটা পাবে না। আসলে আমাদের সরকার যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেভাবে সাড়া দেয় না। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার পরিচয় নির্বেশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার। সেটা এখনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাংলাদেশ এখনো সেই জায়গায় অনেক পিছিয়ে আছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : কামরুল হাসান