শিক্ষার গলে ঝুলছে যে ফাঁস

এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল প্রশ্নফাঁস। পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা—সব ক্ষেত্রেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সর্বশেষ হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ফাঁস হয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নপত্র। এ পরিস্থিতিতে বেশ কিছুদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও অনেক বেড়েছে। এরপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রকৃত উৎসমূল বের করা যায়নি। মূল হোতারা তাই এখনো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

প্রশ্নফাঁস রোধে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অসহায়ত্ব সাধারণ মানুষকে আরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মন্ত্রী কেবল এ জন্য কিছু শিক্ষককে দোষারোপ করছেন। কিন্তু প্রশ্নফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত কাজে আসছে না।

পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতি করতে গিয়ে। অন্যরা পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন।

প্রশ্নফাঁস প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এমনও পরিবারের কথা শুনেছি, যেখানে সন্তান তার বাবা-মাকে বলেছে, আমাকে প্রশ্ন কিনে দাও। সেই বাবা-মা তখন কতটা অসহায় বোধ করেছে, তা আমি বুঝতে পেরেছি। জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিবারগুলোকে এই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার কাজে উৎসাহিত করছে। পরিবারগুলোতে দুর্নীতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এসব ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পাস করা তরুণেরা যখন চাকরির বাজারে ঢুকছে, তখন তারা সেখানে ভালো করছে না। কেননা, তারা তো প্রকৃত মেধাবী না। এমবিএ পাস করা এমন শিক্ষার্থী আছে, যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের জোরে এত দূর এসেছে। তারা ইংরেজির একটি বাক্যও ঠিকমতো লিখতে পারে না। এটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রশ্নফাঁস জাতির গলায় ফাঁসের মতো অবস্থা তৈরি করছে।’

সর্বশেষ ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রসহ আরও আটজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এ বিষয়ে তৎপর। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে দুদক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একগুচ্ছ সুপারিশ পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে কোচিং, নোট-গাইড বই বন্ধ করাসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে মোট ৪০টি সুপারিশ করেছে কমিশন।

সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি ও পরীক্ষাকেন্দ্র হলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস। ওই সব প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে কোচিং সেন্টার, ‘প্রতারক শিক্ষক’ ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র মিলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে দুদক। দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থার মূল্যায়ন হলো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতির নতুন সংযোজন।

গত সাড়ে আট বছরে পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কেবল রাজধানীতেই ৯০টি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া ১২টি মামলায় সাক্ষীর অভাবে আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। বর্তমানে বিচারাধীন অর্ধশত মামলা। তদন্তাধীন ১৯টি। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় সাতটি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন।

‘ফাঁস হওয়া’ প্রশ্নেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা হয়েছে। সম্প্রতি ডিপ্লোমার দ্বিতীয় পর্বের ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং কোর্সের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

এসএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে কয়েক বছর ধরে তাঁরা কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। উঠে এসেছে উদ্ভাস ও ওমেগা নামে দুটি কোচিং সেন্টারের নামও।

গত ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে শহীদুল্লাহ্ হল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মহিউদ্দীন এবং অমর একুশে হলের নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি জানতে পারে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সংঘবদ্ধ চক্র কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে। কারা এই চক্রের সদস্য।

এরপর প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এঁদের মধ্যে ১৩ জন প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির হওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁরা হলেন মহিউদ্দিন রানা, আবদুল্লাহ আল মামুন, ফারজাদ সোবহান নাফী, আনিন চৌধুরী, নাভিদ আনজুম তনয়, এনামুল হক আকাশ, নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, বায়জিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভীর আহেম মল্লিক, প্রসেনজিৎ দাস, আজিজুল হক প্রমুখ। এর মধ্যে নাফী, আনিন ও এনামুল ছাড়া সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নফাঁসের কারণে যারা সত্যিকারের মেধাবী ও পরিশ্রমী, তারা নিরুৎসাহ হয়। দ্বিতীয়ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা পরীক্ষা দেয়, তাদের জীবনের সুনীতির চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। পরিশ্রম ও মেধার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। তৃতীয়ত, যে পরিবারগুলো ফাঁস হওয়া প্রশ্নে সন্তানদের পরীক্ষায় সহায়তা করে সে পরিবারগুলোতে সুনীতির চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।