ফিরে দেখা বিচার বিভাগ ২০১৭: সবচেয়ে আলোচিত বিদায়

বক্তব্য, পাল্টা-বক্তব্য, আকস্মিক ছুটিতে যাওয়া, পরে বিদেশে যাওয়া, আর সেখান থেকে পদত্যাগ-বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদায়কে ঘিরে বছরের শেষ তিনটি মাস ছিল আলোড়নময়। বিচারপতি সিনহা দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে পদত্যাগকারী প্রথম প্রধান বিচারপতি হয়ে রইলেন।

প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত ২ বছর ৯ মাস ২৫ দিনের দায়িত্ব পালনকালে আলোচনা পিছু ছাড়েনি বিচারপতি সিনহার। তবে এই আলোচনা আর বিতর্ক চূড়া স্পর্শ করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে তাঁর লেখা রায় নিয়ে। গত ১ আগস্ট আপিল বিভাগের সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পাওয়ার পরের আড়াই মাসে ঘটে নানা ঘটনা, যা প্রথমে ছুটি ও পরে ১০ নভেম্বর তাঁর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
বিচারপতি সিনহার সঙ্গে সরকারের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব আরও কিছু আগে থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করে। বিশেষ করে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা নিয়ে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কথা চালাচালিতে এটি প্রকটভাবেই দৃশ্যমান হয়। প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে বেশি কথা বলে ফেলছেন বলে ২৬ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মন্তব্য করেন।
এরপর গত ৩০ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, বিশ্বের সর্বত্র যে নিয়ম চালু আছে, এখানে তা চালু করা যাচ্ছে না বলেই প্রধান বিচারপতিকে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হচ্ছে।
অধস্তন আদালতে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত ওই বিধিমালা জারি করা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিচারপতি সিনহার এভাবে টানাপোড়েন চলতেই থাকে।

ছুটিতে থাকা অবস্থায় ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি সিনহা
ছুটিতে থাকা অবস্থায় ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি সিনহা

এরই মধ্যে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে নিতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষিত হয়। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ ৩ জুলাই আপিল খারিজ করে রায় দেন। এর পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন।
রায়ের এসব পর্যবেক্ষণ বা মত নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা নতুন মাত্রা পায়। ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ। অন্যদিকে রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগ রায় বাতিলের জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ওই রায়ে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির ‘অসাংবিধানিক, আপত্তিকর, অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ’ বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়।

এর আগে গত ২৭ আগস্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শুরু হয়, ৩ অক্টোবর নিয়মিত সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিন ছিল। এর ঠিক এক দিন আগে ২ অক্টোবর এক মাস ছুটির কথা জানিয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি দেন, যার মেয়াদ ছিল ১ নভেম্বর পর্যন্ত। এদিন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এরপর নতুন আলোচনা শুরু হয়। বছরের ৪ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ছুটির চিঠি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, যেখানে বলা হয়, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিনও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।
তবে প্রধান বিচারপতিকে ‘গৃহবন্দী’ করে রাখা হয়েছে বলে ৫ অক্টোবর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ছুটি নিয়ে দুই দিন রাজধানীর হেয়ার রোডে অবস্থিত সরকারি বাসভবনে অবস্থান শেষে সেদিনই জনসমক্ষে বের হন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। প্রথম দফায় গুলশানে ভিসা সেন্টারে যান, দ্বিতীয় দফায় বাসভবন থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে বিকেলে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সস্ত্রীক যান তিনি।

এর পাঁচ দিন পর ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ১৩ অক্টোবর বা কাছাকাছি সময়ে বিদেশে যাওয়া এবং ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছা পোষণের বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে প্রধান বিচারপতির বর্ধিত ছুটিকালে বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নভেম্বর হতে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বা প্রধান বিচারপতির পুনরায় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর প্রধান বিচারপতি সিনহা অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে গত ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ছাড়েন। এর আগে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, তিনি সুস্থ আছেন। ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী যেভাবে তাঁর সমালোচনা করেছেন, এতে তিনি বিব্রত।
বিচারপতি সিনহার লিখিত ওই বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক বলে অভিহিত করে পরদিন বিবৃতি দেন সুপ্রিম কোর্ট। এতে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ-সংবলিত দালিলিক তথ্যাদি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কাছে হস্তান্তর করার প্রসঙ্গ ছিল।

গেল ১৫ অক্টোবর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে যে ১১টি অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার অনুসন্ধান করবে। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে যান বিচারপতি সিনহা। গেল ১২ অক্টোবর জারি করা সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হয় ১০ নভেম্বর। সিঙ্গাপুরে অবস্থান শেষে কানাডায় যাওয়ার পথে ওইদিন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি নিয়োগ পান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যা ১৭ জানুয়ারি কার্যকর হয়। তাঁর চাকরির মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর ৮২ দিন আগে দেশের বাইরে থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।