সুন্দরবন ধ্বংস হলে দায় সরকারের

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বদরুল ইমাম। তাঁর ডানে সুলতানা কামাল ও আনোয়ার হোসেন l প্রথম আলো
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বদরুল ইমাম। তাঁর ডানে সুলতানা কামাল ও আনোয়ার হোসেন l প্রথম আলো

সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ৩২০টি শিল্পকারখানা ও প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের ঐতিহ্য ও জাতীয় সম্পদ সুন্দরবন সর্বোচ্চ হুমকির সম্মুখীন। এটি ধ্বংস হলে এর দায় বর্তমান সরকারের ওপর বর্তাবে।

গতকাল শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। কমিটি রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে একটি উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সুন্দরবন রক্ষা কমিটি রামপাল প্রকল্পের ওপর ১৩টি গবেষণা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছিল। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দুই মাস পরও সরকারের দিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। কমিটির নেতারা বলেন, সরকারের এই নীরবতাই এসব প্রতিবেদনের সত্যতা স্বীকার করে নেয়। তাঁরা এ বিষয়ে সরকারের কাছে জবাব চান।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল ও জামদানি শাড়িকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এতে সবাই আনন্দিত। সরকারও খুশি হয়েছে। আড়ম্বরের সঙ্গে এই অর্জনকে উদ্‌যাপন করেছে। কিন্তু সেই ইউনেসকো যখন রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে বলে অভিযোগ তুলছে, প্রকল্পটি বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে, তখন সরকার তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

উল্টো ইউনেসকোর সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ইউনেসকো নাকি রামপালের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। রামপাল তো দূরে থাক, সুন্দরবনের চারপাশে কোনো ধরনের শিল্পকারখানা না করার আহ্বান জানিয়েছে ইউনেসকো। কিন্তু সরকার সুন্দরবনের পাশে ৩২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কারখানা করার অনুমতি দিয়েছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিবেশবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্কের (বেন) সমন্বয়কারী অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের পাশে ও পশুর নদীর তীরে রামপালসহ ৩২০ প্রকল্প ও কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। আশির দশকে এভাবে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা করে আজকে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আলকাতরার মতো করা হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে পশুর নদীর পানিরও একই অবস্থা হবে। তখন এই সুন্দরবন আর থাকবে না।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ সৌরবিদ্যুতের কাছাকাছি চলে গেছে। ভারত-চীনসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সবাই সৌরবিদ্যুতের দিকে যাচ্ছে। আর আমাদের সরকার দেশের বিদ্যুতের ৭০ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।’ এসব বুদ্ধি সরকারকে কারা দেয়—সেই প্রশ্ন তোলেন এই অর্থনীতিবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম বলেন, রামপাল প্রকল্পের কাজ যেভাবে সরকার এগিয়ে নিচ্ছে তাতে সুন্দরবন নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে। সুন্দরবন ধ্বংসের দায় বর্তমান সরকারের ঘাড়ে চাপবে।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন পাঁচটি সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরেন। তা হচ্ছে রামপাল প্রকল্পের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা, জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া ১৩টি গবেষণা প্রতিবেদন ও ইউনেসকোর সুপারিশ মেনে এই বন রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া। ওই সব গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের কোনো বিজ্ঞানসম্মত দ্বিমত থাকলে তা তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেওয়া। সরকার ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির মধ্যে একটি উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করা এবং তাতে গণমাধ্যমকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। সুন্দরবনের চারপাশের ৩২০টি শিল্পকারখানা বাতিল করা এবং সুন্দরবনের ওপর সব চাপ বন্ধ করা।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য শরীফ জামিল।