হরতালবিহীন 'শান্ত' রাজনীতি

আগের বছরের মতো এ বছরটিও রাজনীতির ময়দান ছিল অনেকটাই শান্ত। বছরের শেষভাগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় এবং প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ নিয়ে কিছুটা উত্তাপ। ২০১৮ সালে ভোটের বছরে প্রবেশের আগে এ বছরটি ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আলোচনায় কেটেছে।
এ বছর বিএনপি কোনো হরতাল ডাকেনি। দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এক দিন পূর্ণদিবস হরতাল দেয় জামায়াতে ইসলামী। তবে এতে বিএনপি সমর্থন দেয়নি। আর এই হরতালে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকই ছিল। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কয়েকটি বাম দল আধা বেলা করে দুবার হরতাল ডাকে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে অর্ধবেলা হরতালে বিএনপি সমর্থন দেয়। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা আধা বেলা হরতালেও বিএনপি সমর্থন দেয়। বাম দলগুলোর হরতালে পুলিশ কিছুটা চড়াও হয়।

খালেদা জিয়ার মামলা
বছরের শেষ দিকে এসে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা সবচেয়ে আলোচিত ঘটনায় রূপ নেয়। এই মামলার মূল আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিচার এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। নতুন বছরের শুরুতেই রায় হয়ে যেতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী যুক্তিতর্কে অংশ নিয়ে খালেদা-তারেকসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছেন। আর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাঁদের যুক্তিতর্কে এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে খালাস চেয়েছেন।

এই মামলাকে ঘিরে এখন রাজনীতিতে মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, খালেদা জিয়া জেলে যাচ্ছেন কি না। মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলে এবং তিনি কারাগারে গেলে বিএনপির প্রতিক্রিয়া কী হবে? সাজা হলে খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন? তারেক রহমান কি দেশে ফিরে এসে মামলা মোকাবিলা করবেন?
অনেকেই মনে করছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর নতুন বছরে স্পষ্ট হবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা খালেদা জিয়ার মামলা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন। কিন্তু তাঁদের সামনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিসহ নানা রাজনৈতিক বিষয়ও রয়েছে। ফলে তাঁরা কোনটার জন্য মাঠে নামবে, এটা একটা বড় প্রশ্ন।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা চলমান আছে। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম সবচেয়ে এগিয়ে। বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসায় স্থাপিত বিশেষ আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা আছে শতাধিক।

নতুন জোট ও দলের আত্মপ্রকাশ
এ বছর বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক জোট ও দল গঠন হয়েছে। গত ৭ মে দুটি দল ও দুটি রাজনৈতিক জোটের সমন্বয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ) নামের একটি ‘বৃহত্তর জোট’ গঠনের ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। এই জোটে দুটি নিবন্ধিত দলসহ মোট ৫৮টি দল রয়েছে। সংখ্যার বিচারে এটা এখন দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জোট। জোটের চেয়ারম্যান এরশাদ। জোটের বেশির ভাগ দলের নামের আগে-পরে ‘ইসলামী’ বা ‘ইসলাম’ শব্দ যুক্ত আছে। এটাকে ইসলামি মূল্যবোধের জোটও আখ্যা দেন এরশাদ। তবে জোট গঠনের পর এর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

৪ ডিসেম্বর রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর নাম দেওয়া হয় ‘যুক্তফ্রন্ট’। জোটের দলগুলো হলো বিকল্পধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ঐক্য। এই জোটে আরও নতুন রাজনৈতিক দল যুক্ত হবে—এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত নতুন কারও যোগ দেওয়া বা জোটের কর্মসূচি শোনা যায়নি।

গত ২০ সেপ্টেম্বর নামসর্বস্ব হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান আদিবাসী পার্টিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি) নামে একটি দল গঠন করা হয়। এর দুই দিন পর বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি) নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ারও ঘোষণা দেয় তারা। এই দল দুটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদনও করেছে।

হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্য
স্তিমিত হেফাজতে ইসলামে আবার নড়াচড়া দেখা দেয় এ বছর। পাঠ্যপুস্তকে ২৯টি বিষয় পরিবর্তনে লিখিত প্রস্তাব দেয় তারা এবং তাদের দাবির সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনও আনা হয়।

১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের আমিরসহ শীর্ষ নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। কওমি শিক্ষায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করেই দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তরের সমমান প্রদান করা হয়। ওই বৈঠকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা গ্রিক থেমেসিসের ভাস্কর্য অপসারণেরও দাবি তোলে হেফাজত। প্রধানমন্ত্রীও এতে সায় দেন।

এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটিকে ‘গ্রিক দেবির মূর্তি’ আখ্যায়িত করে তা অপসারণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে স্মারকলিপি দেয় হেফাজতে ইসলাম। ভাস্কর্য না সরালে প্রতিবাদ কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। এই দাবিতে সরকারের অনুগত আওয়ামী ওলামা লীগসহ অন্য ইসলামি দলও যোগ দেয়। ২৫ মে রাতে ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়।
সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা হেফাজতে ইসলাম-সম্পর্কিত সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। তবে ভেতরে ভেতরে কেউ কেউ এর সমালোচনাও করেন।

রাজনৈতিক কর্মসূচির পালে হাওয়া
বছরের প্রায় পুরোটা জুড়েই ঘরোয়া কর্মসূচি পালনে সীমাবদ্ধ থাকে বিরোধীরা। বছরের শেষের দিকে এসে ঘরের বাইরে কর্মসূচি পালনের সুযোগ পায়।
শুরুটা হয় ১৮ অক্টোবর। ওই দিন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে পথে পথে নেতা-কর্মীরা তাঁকে স্বাগত জানান। এতে বিপুল মানুষের জমায়েত হয়। এরপর ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়া সড়কপথে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে কক্সবাজার সফরে বের হন। পথে পথে তাঁর সফর ঘিরে বিপুল জমায়েত করে বিএনপি। ফেনী ও চট্টগ্রামে খালেদার গাড়িবহরে হামলা হয়। তবে আসা-যাওয়া মিলিয়ে তিন দিনের এই সফর বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

দীর্ঘদিন পর ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পায় বিএনপি। ওই সমাবেশে বিপুল জমায়েতও করে দলটি। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে অংশ নেন খালেদা জিয়া।

সরকারি দল আওয়ামী লীগ সারা বছরই কোনো না কোনো কর্মসূচি পালন করেছে। তবে অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়ায় তা উদ্‌যাপনে গুরুত্ব দেয় দলটি।
সরকার ও বিএনপি জোটের বাইরে থাকা বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও হেফাজতের দাবি মেনে নেওয়ার বিরোধিতা করে হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালন করে।

অভ্যন্তরীণ সহিংসতা
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জর্জরিত আওয়ামী লীগ। এ বছরটাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রাণহানির যে ঘটনা ঘটেছে, এর পুরোভাগেই দেখা গেছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের, সহযোগী সংগঠনগুলোর মারামারি লেগেই ছিল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৩২১টি। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪১৫ জন।

এর মধ্যে ১৮৯টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে। এসব ঘটনায় ৩৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন ২ হাজার ৭৫৬ জন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রাণহানি ধরলে গত ১১ মাসে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ৪০ জনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘাতে প্রাণ গেছে ২৮ জনের। আর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে মারা যান ৩ জন।

রাজনীতিকদের প্রয়াণ
এ বছর বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের প্রয়াণ ঘটেছে। সর্বশেষ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক ১৬ ডিসেম্বর সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর আসন থেকে তিনি পাঁচবারের সাংসদ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই রাজনীতিক ২০১৪ সালে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

গত ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত ভোররাতে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ১৬ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নামে আসে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার ২৪ অক্টোবর নিজ বাসায় মারা যান। আমলা থেকে রাজনীতিতে আসা এই বর্ষীয়ান নেতা দীর্ঘদিন রোগে ভুগছিলেন। ১৯৯০ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসরে যান। এরপর ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে কুমিল্লার হোমনা আসন থেকে টানা পাঁচবার সাংসদ হন।

এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ও আওয়ামী লীগের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা যান। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই নেতা। স্বাধীনতার পর সাতবার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। ২০১১ সালে তিনি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করেন।