উত্তেজনায় শুরু, অস্থিরতায় শেষ

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আজ বিদায়ী বছরের শেষ দিন। কাল নতুন বছরের শুরু। এরই সন্ধিক্ষণে শত শত শিক্ষক ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে অবস্থান করছেন টানা পাঁচ দিন ধরে। আজ রোববার বছরের শেষ সূর্যোদয়ের দিন থেকে আমরণ অনশন শুরু করবেন। অনশনে সূচনা হবে তাঁদের নতুন বছর। তাঁদের দাবি এমপিওতে অন্তর্ভুক্তির (বেতনের সরকারি অংশ পাওয়া)।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কয়েকটি সংগঠনও আজ বছরের শেষ দিনটিতে ধর্মঘটের কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে। প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত সব স্তরে ছড়িয়ে আছেন ক্ষুব্ধ শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাঁদের মোট সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। তাঁদের দাবির যুক্তি-অযুক্তি যা-ই থাক, স্তরভেদে কর্মসূচি সবার আলাদা।

২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি ও বেসরকারি, এমপিওভুক্ত ও বহির্ভূত, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার-সব শিক্ষক নিজ নিজ দাবি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর ও নোট-গাইডে শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়া যখন লাটে ওঠার পথে, শিক্ষকদের এই অসন্তোষ তাতে হয়ে উঠবে বোঝার ওপর শাকের আঁটি। আগামী বছর কেমন যাবে, তার একটি ইঙ্গিত মিলছে এই ছবি থেকে।

বিদায়ী বছর শুরু হয়েছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের দাবি মেনে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন এনে। প্রগতিশীল নানা সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে সরকার সেসব কানে তোলেনি।

বছরটি বিদায় নিচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্ক গায়ে নিয়ে। নিয়োগ, ভর্তি বা পাবলিক-প্রশ্ন ফাঁস হয়নি এমন পরীক্ষা খুব কমই হয়েছে। বছরের সমাপ্তি হলো বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস দিয়ে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বললেন, শিক্ষায় সব অগ্রগতি ম্লান হয়ে গেছে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায়। তাঁর মতে, স্কুলে ছেলেমেয়ে বেড়েছে, বই দেওয়া হচ্ছে সময়মতো, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের বই, ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ-এসব ভালো অর্জন। কিন্তু পুরো শিক্ষা পরীক্ষানির্ভর করে তোলায় নির্ভরতা বেড়ে গেছে কোচিং ও নোট-গাইডের ওপর। শিক্ষাকে এ থেকে বাঁচানো জরুরি।

অস্থির আদালত
২০১৭ সাল ছিল বিচার বিভাগের জন্য দুর্যোগের বছর। বিশেষ পরিস্থিতির মুখে দেশে এই প্রথম প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।
গত ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও পর্যবেক্ষণ দেন। একে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠায় প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান। ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর তিনি সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান।
বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সমর্থক বলে পরিচিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বলছে, প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আর সরকার বলছে, দায়িত্বরত অবস্থায় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ায় তিনি চলে যেতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এক বছরে দেড় শর বেশি ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার রেকর্ড হয়েছে এবার। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় হাইকোর্ট তিন র‍্যাব কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেনসহ ১৫ জনের এবং বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।

গুম, নিখোঁজ ও ফিরে আসা
একাধিক গুমের ঘটনা বছরজুড়ে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫ জন। পরে ৩৬ জনের হদিস পাওয়া যায়। মৃতদেহ পাওয়া যায় ৭ জনের। এখন অব্দি নিখোঁজ ৩২। খোঁজ পাওয়া ৩৬ জনের মধ্যে অন্তত ১৭ জনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ বা র‍্যাব।
কারা কীভাবে গুম করছে, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। আবার নিখোঁজ হয়ে পরে ফিরে আসা ব্যক্তিদের কেউ মুখ খোলেননি। কবি ফরহাদ মজহার ব্যতিক্রমী হয়ে মুখ খুলে মামলায় পড়েছেন। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সরকারের কোনো না কোনো মহলের জ্ঞাতসারেই গুমের ঘটনা ঘটছে। তাঁদের মত, সরকার যদি না-ও জানে, তবু ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাঁদেরই।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ফিরে আসা ব্যক্তিদের কথা বলানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে আশ্বাস দিতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে কথা বললে তাঁরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।

জঙ্গি দমনের বছর
প্রগতিশীল লেখক-প্রকাশক ও সংখ্যালঘুদের বেছে বেছে হত্যা করা থেকে শুরু করে গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মতো দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সাল ছিল জঙ্গি দমনের বছর। ২১টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এ বছর নিহত হয়েছে ৪১ সন্দেহভাজন জঙ্গি। নিহত হয়েছে অন্তত ৮ শিশুও। সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় শুরু হয়েছিল বছরের প্রথম অভিযান। শেষ হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি ইউনিয়নের পদ্মার চরে। জঙ্গি দমনের ঘটনায় সরকার প্রশংসিত হয়েছে, তবে জঙ্গিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা যায়নি।

সুলতানা কামাল বলেন, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে জঙ্গিবাদবিরোধী চেতনা ধারণ করতে হবে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে রাজনীতিবিদেরা মৌখিকভাবে যে আশ্বাস দেন, সেটি তাঁদের আচার-আচরণ ও ব্যবহারে প্রতিভাত হতে হবে।

ইসি গঠন ও সংলাপ
বিতর্কিত রকিবউদ্দীন কমিশনের উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) কারা আসছেন-সে উত্তেজনায় সরগরম ছিল বছরের প্রথম ৩৭ দিন। একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে ৭ ফেব্রুয়ারি নতুন ইসি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গত ১৬ জুলাই পথনকশা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নতুন এই ইসি। এরপর থেকে আলোচনায় ছিল ইসির সংলাপ। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দল, নারীনেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। সেনা মোতায়েন, নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ বহাল রাখা না-রাখা নিয়ে সংলাপে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মূল প্রস্তাবগুলো ছিল বিপরীতমুখী।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের অধীনে প্রথম নির্বাচন ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের। সে নির্বাচনে কিছু কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে সিল দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন ছিল মোটামুটি সুষ্ঠু। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। তাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। রংপুরে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে ৬৫ শতাংশ, বিএনপির বেড়েছে ৪১ শতাংশ।

ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের অকালমৃত্যুর পর মেয়রের শূন্য পদে নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। পাশাপাশি এ নির্বাচনের ঝুঁকি সরকার নেবে কি না, তা নিয়েও কথা হচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি গঠিত অনুসন্ধান কমিটির সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রংপুরে নির্বাচন কমিশন সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে আগামী নির্বাচনগুলো, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে ইসি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

দুদক তৎপর, তবে...
দুদকের একধরনের তৎপরতা ছিল। ফাঁদ পেতে কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু বড় দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে তদন্ত না করায় দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বছরের শেষ দিকে এসে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ কয়েকজনকে তলব করে দুদক।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জন্মলগ্ন থেকে বিবেচনা করলে বিদায়ী বছরে দুদক দৃঢ় অবস্থানে ছিল। তবে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের বেলায় দৃঢ়তায় ঘাটতি দেখা গেছে। তাঁর মতে, আইনের চোখে যে সবাই সমান-দুদককে এটা প্রমাণ করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষতায় দুদক কর্মকর্তাদের যেসব ঘাটতি আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।

পাহাড়ধস, অকালবন্যা
বিদায়ী বছর খাবি খেয়েছে তিনটি অতি আলোচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে। গত মার্চে পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ১৪২টি হাওরের ফসল ডুবে যায়। ক্ষয়ক্ষতি হয় হাওরের মানুষের জীবন ও সম্পদের। উত্তরাঞ্চলে বন্যায় মারা যায় ১৫০ জন। ৩২ জেলার ২০৮টি উপজেলা প্লাবিত হয়। জুন মাসে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে মারা যায় ১৫৮ জন।

জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে নিহত হন ১৭০ জন। চিকুনগুনিয়ায় ঢাকা শহরের ১৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। এই রোগের প্রাদুর্ভাব জনমনে ভীষণ আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

বাল্যবিবাহ রুখে দাঁড়ানোর বছর
দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনার পর চলতি বছরেই আলোর মুখ দেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন। আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ (২১ অনূর্ধ্ব) ও নারীর (১৮ অনূর্ধ্ব) বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ১৯ ধারায় ব্যতিক্রম হিসেবে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বাল্যবিবাহের জন্য বিশেষ বিধান রাখায় এর অপপ্রয়োগের শঙ্কা জানান নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা।

২০১৭ বাল্যবিবাহ রুখে দাঁড়ানোর বছর ছিল। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ছিল নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ-ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের। কেবল ঢাকা বিভাগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৮৮৫টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।

ধর্ষকেরা যখন প্রভাবশালী
ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনা বছরজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা হয়ে উঠেছিল অতি আলোচিত। এ ঘটনায় প্রভাবশালী পরিবারের পাঁচ যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর মাসহ তার মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় বগুড়ায় তুফান সরকার গ্রেপ্তার হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে, এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৪৯টি, ধর্ষণের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ৯৭টি এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১টি।

সরকারের অস্বস্তি
বিদায়ী বছরে সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে বেশ কয়েকটি ঘটনায়। তিন আলোচিত পণ্য ছিল চাল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ। আরও বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দামের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি সরকারকে বিব্রত করে।

খেলাপি ঋণ ছিল বছরভর আলোচনার বিষয়। এর পরিমাণ এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় ফারমার্স ব্যাংক, এসআইবিএল এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পড়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির অবস্থাই খারাপ। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ সরকারের হাতে নেওয়ার বিষয়টি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নজিরবিহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে, দলীয় কোন্দলে গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৭ নেতা-কর্মী খুন হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতে মারা গেছে ৪৯ জন।
ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মাদক ও যানজট নাগরিক জীবনকে এ বছর দুর্বিষহ করে রাখে। প্রথম আলোর হিসাবে, এ বছরের শেষ ৩১৬ দিনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭২।

প্রবীণ শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা যেভাবে বাড়ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। দেশে উন্নতির পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে। এর নিরসন জরুরি। ‘বছরের এই সন্ধিক্ষণে আমার চাওয়া দুটি-নাগরিক নিরাপত্তা বাড়ানো, আর বৈষম্য কমানো।’

বড় চাপ রোহিঙ্গা-ঢল
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের মানবতা ও উদারতা বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়েছে। মাত্র চার মাসে ৬ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নজিরবিহীন আতিথ্য বিশ্ববাসীকে হতবাক করে।

সরকারি হিসাবে, এবারের ৬ লাখ ৫৫ হাজার, গত বছরের অক্টোবর থেকে এবারের জুন পর্যন্ত ৮৭ হাজার, দুই নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের জাতিসংঘের ৩৩ হাজার এবং অনিবন্ধিত প্রায় ৩ লাখ মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৭৬ হাজার।

আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তারা কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কাউন্সিলে বেশ কয়েকবার ভোটাভুটি, বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। তবে এ সংকটে বাংলাদেশ তার কাছের বন্ধু ভারত, চীন ও রাশিয়াকে যেভাবে পাশে চেয়েছিল, সেভাবে পায়নি।

রাজনীতি দৃশ্যত শান্ত
বিদায়ী বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি শান্ত। রাজনীতির চালকের আসনে ছিল সরকার তথা সরকারি দল আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দল সভা-সমাবেশ করার জন্য বারবার সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে। কখনো সীমিত অনুমতি পেয়েছে। মাঠে বিএনপির সফল কর্মসূচি ছিল খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর। এই সফরকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঙা হন।

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল খালেদা জিয়ার মামলা। খালেদা জিয়ার মামলার রায়, সাজা হলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না-এসব নিয়ে আগাম জল্পনা-কল্পনা চলেছে বছরভর।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছর ছিল ‘ঝড়ের আগে শান্ত অবস্থা’। আগামী বছর হবে ঝড়ের বছর। কারণ, ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন রয়েছে, যেখানে পাওয়া ও হারানোর সম্ভাবনা আছে। তবে একটি অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত নির্বাচন দেশকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই আগ্রহ, কৌতূহল ও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সংকটকাল অতিক্রম করে বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে কি না-এটা এখন পর্যন্ত বড় প্রশ্ন।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যেভাবে ঝিমিয়ে পড়ছিল, তাতে নিজের শক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে হবে। সহায়ক সরকারের দাবি সরকার মানবে না। এ জন্য দলটি আন্দোলন করবে। কিন্তু সেই আন্দোলন আগের মতো সহিংস হলে বিএনপি জনসমর্থন হারাবে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, দলটি অনেকটাই ঘর গুছিয়েছে। তবে অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে এমনিতেই ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা কমে। তার ওপর দলীয় কোন্দল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যানজটসহ নানা কারণে মানুষ বিরক্ত। তাদের উচিত হবে জনসংযোগ বাড়ানো এবং ভোটারদের মন জয় করা।