রাজনীতির আমূল পরিবর্তন দরকার

আবুল কাসেম ফজলুল হক
আবুল কাসেম ফজলুল হক

সারা বছরের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনীতি বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রথম আলো: সারা বছরের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি কেমন দেখলেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এককথায় বললে ২০১৭ সালে আগের বছরের ধারাবাহিকতাই বহাল থাকল। এর মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে জনশ্রুতি আছে যে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। এবার দেখা যাচ্ছে হাকিম বিদায় নিয়েছেন। হুকুমও বদলে যাবে। এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অনেক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তাই তাঁর এই পদত্যাগ ও দেশত্যাগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে রাজনীতিতে। রোহিঙ্গা সমস্যা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও বড় ঘটনা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাব পেয়েছেন। তবে তাদের নাগরিকত্ব দরকার, দেশে ফেরত পাঠানো দরকার। এর জন্য তৎপরতা চালাতে হবে। দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন দুঃসহ। রাজনীতির উন্নতি ছাড়া এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

প্রথম আলো: রাজনীতির কোনো গুণগত পরিবর্তন কি চোখে পড়েছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আলোচনা ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা গুরুত্ব পায়নি। দেশে গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে নির্বাচনে। এই নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্র এবং বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সামর্থ্য রাখে না। রাজনীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। এটা নিয়ে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নতুন চিন্তা দরকার। দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের চিন্তা করা যেতে পারে।

প্রথম আলো: নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা পরিসর বেড়েছে না কমেছে? জাতীয় সংসদের কার্যক্রম কেমন দেখলেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: যে রাজনীতি এখন চলছে এর প্রকৃতি স্বৈরাচারী। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের সুযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। মত বলতে আমি সর্বজনীন কল্যাণে প্রগতিশীল মতের কথা বলছি। জাতীয় সংসদও অর্থহীন। সেখানে একদলীয় ব্যবস্থা, তাতে মত প্রকাশের কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। জাতীয় পার্টি কোনো বিরোধী দলই নয়। ক্ষমতা যেখানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত, সেখানে মত প্রকাশের সুযোগ অল্পই আছে। সরকারের বাইরে যেসব দলের অবস্থান, কোনোটি থেকেই সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। আসলে রাষ্ট্র গঠনে এবং জনজীবন পরিচালনায় সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর যে ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে, তা জাতীয় ব্যর্থতা। প্রচারমাধ্যমও নতুন প্রগতিশীল চিন্তার অগ্রগতিতে সহায়তা করতে সাহসী হচ্ছে না।

প্রথম আলো: নতুন বছরটা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেমন যাবে বলে মনে করছেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীন দলের যে প্রতাপ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই নির্বাচনের মাধ্যমে অবস্থার কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হোক এটা চাই। তবে সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রস্তুতির দরকার, রাজনৈতিক চরিত্রের যে উন্নতি দরকার, তা আরও বেশি করে চাই। এত নিকৃষ্ট চরিত্রের রাজনীতি দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা সোনার পাথরবাটির মতো ব্যাপার। আগামী নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি পূরণ হবে বলে মনে হয় না। যদি তা হয়ও, এর দ্বারা রাজনীতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। যে অবস্থা চলছে তাতে প্রশাসন নির্বাচনকালে পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে থাকবে-এমনটা আশা করা যায় না।

প্রথম আলো: আগামীতে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সংলাপের কথা বলা হচ্ছে নানা মহল থেকে। এটা একটা বহুল আলোচিত শব্দ। এই বিষয়ে আপনার মত কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ-মতবিনিময় দরকার। সেটা সুস্থ রাজনৈতিক অবস্থায় অবশ্যই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদ ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সর্বদলীয় কোনো সংলাপ হয়নি। এটা রাজনৈতিক অস্বাভাবিকতার পরিচায়ক। এই পরিস্থিতে সংলাপ কঠিন বিষয়। আগামী নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সর্বদলীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। সরকার ও সরকারি দলের নেতারা অন্য সব দল ও তাদের নেতাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলবেন-এটাই গণতন্ত্রের দাবি।