জমি দখলে নেওয়ার কৌশল

রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের গোয়ালন্দ মোড়ে আদালতের আদেশ অমান্য করে বিচারাধীন জমিতে ঘর তোলা ও সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ছবিটি গত মঙ্গলবারের l প্রথম আলো
রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের গোয়ালন্দ মোড়ে আদালতের আদেশ অমান্য করে বিচারাধীন জমিতে ঘর তোলা ও সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ছবিটি গত মঙ্গলবারের l প্রথম আলো

রাজবাড়ীতে আদালতের আদেশ অমান্য করে জমিতে ঘর তোলা হয়েছে। দখল পাকাপোক্ত করতে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা নামে সংগঠনের সাইনবোর্ড টাঙানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জমি দখলের অভিযোগে সেকেন্দার মিয়া বাদী হয়ে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১৪ ডিসেম্বর মামলা করেছেন। সেকেন্দার মিয়া ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশানগোপালপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা। মামলায় আবদুল লতিফ গাজীকে ১ নম্বর ও রাজীব তালুকদারকে ২ নম্বর আসামি করে মোট পাঁচজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রাজীব তালুকদার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) এবং বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা রাজবাড়ী জেলা কমিটির সহসভাপতি। লতিফ গাজীর বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের নিমতলা গ্রামে।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় মিল মাঠের পাশে টিনের লম্বা ঘর তোলা হয়েছে। ঘরের সামনে প্রথম ঘরটিতে একটি বড় সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। সাইনবোর্ডের ডান পাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি। এতে লেখা রয়েছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল কর্তৃক অনুমোদিত বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা, আঞ্চলিক কার্যালয়, গোয়ালন্দ মোড়, রাজবাড়ী।

মামলার বাদী সেকেন্দার আলী মিয়া বলেন, ‘আমি ১৯৬৭ সালে আবদুস সামাদ শেখের কাছ থেকে ৩৮ শতাংশ জমি কিনি। আমার নামে জমি রেজিস্ট্রির কাগজপত্র আছে। আমার ছোট ভাই সেলিম মিয়া ১৯৮১ সালে ভুয়া দলিল করেন। ২০০৮ সালে ভুয়া দলিলের বিষয়টি আমি জানতে পারি। এরপর রাজবাড়ী সদর কোর্টে মামলা করি। মামলা চলাকালে সেলিম মিয়া ১৯ শতাংশ জমি আবদুল লতিফ গাজীর কাছে বিক্রি করেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর লতিফ গাজীরা জমি দখল করতে আসেন। এ সময় আমরা বাধা দিই। এ বিষয়ে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করি। আদালত ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু পরের দিন রাতে ওই জমি থেকে আগের একটি দোকান সরিয়ে তাঁরা টিনের ছাউনি দিয়ে লম্বা ঘর তোলেন। গত রোববার তারা ঘরটিতে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা নামে সংগঠনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও মুদি দোকানি ফরহাদ খান বলেন, ‘আমি ১৫-১৬ বছর আগে সেকেন্দার সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ওই জমিতে মুদি দোকান করি। একটি বটগাছও লাগিয়েছিলাম। দোকানে বিদ্যুতের মিটারও ছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে আমার দোকানটি তুলে মিলের মাঠে রেখে দেওয়া হয়েছে।’

পাশের আরেক দোকানি সোহাগ ব্যাপারী বলেন, ‘লতিফ গাজীর নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু লোক একদিনঘরের চালা দিয়েছেন। পরে সব কাজ রাতে করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিন দোকানপাট বন্ধ করে চলে যাই। সকালে ফিরে এসে একটু একটু করে কাজ করা দেখতে পাই। কয়েকবার পুলিশ এসে কাজ বন্ধ রাখতেও বলে গেছে।’

বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা রাজবাড়ী জেলা শাখার সহসভাপতি সুশান্ত কুমার দাস বলেন, ‘শহরের বড়পুল এলাকায় আমাদের জেলা সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়। জেলা কমিটি ছাড়া আমাদের সংগঠনের আর কোনো কমিটি নেই। ফলে এখন পর্যন্ত কোনো আঞ্চলিক কার্যালয়ও নেই। আর লতিফ গাজীর সঙ্গে আমাদের কোনো সাংগঠনিক সম্পর্কও নেই। বিরোধপূর্ণ জমিতে সংগঠনের নামে জমি দখলের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করি। যেকোনো দখল বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাই। ওই জমি কে বা কারা দখল করেছে, তা আমাদের জানা নেই। সংগঠনের কেউ জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব বলেন, ‘বিতর্কিত জমিতে এই সংগঠনের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো দুঃখজনক। এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় আমাদের কোনো কমিটি বা কার্যালয় নেই।’

আবদুল লতিফ গাজী বলেন, ‘ওই জমি আমি নয় বছর আগে কিনেছি। কয়েক দিন আগে ছয়টি ঘর তুলেছি। পুলিশ বাধা দেওয়ায় এখনো ঘরের ভেতরে পার্টিশন দেওয়া হয়নি। রাজীব তালুকদার আমার আত্মীয় হয়। তাঁর কাছে মাসিক এক হাজার টাকা চুক্তিতে ভাড়া দিয়েছি।’

দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাজীব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘লতিফ আমার আত্মীয়। আমরা কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলার আঞ্চলিক কমিটি করেছি। কিন্তু বিষয়টি এখনো সংগঠনের তেমন কাউকে জানানো হয়নি। আমি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিকেলে বসার জন্য ওই জমি ভাড়া নিয়ে ঘর করে দিয়েছি।’

খানখানাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন খান বলেন, ‘ওই নামে সংগঠনের কোনো আঞ্চলিক কমিটি আছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় এই সংগঠনের কোনো কার্যক্রম কখনো চোখে পড়েনি। সংগঠন থাকলে নিশ্চয়ই কমবেশি কার্যক্রমও চলত।’

খানখানাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নূরুজ্জামান শেখ বলেন, ‘১৪৪ ধারা জারি হওয়ার পর আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি। এখন আমি ছুটিতে আছি। এই মুহূর্তে কী অবস্থা, তা বলতে পারব না।’