ডট কম কথা কম

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ। ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ। ছবি: প্রথম আলো

বছরের শুরুতে কিছু প্রতিজ্ঞা করবার চল আছে। একে বলে নিউ ইয়ারস রেজল্যুশন। গত বছর করতে পারিনি, আগামী বছর যেন করতে পারি। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। তেমনি করে: নতুন বছরে আমি জোরে জোরে বলি, সারাটা বছর যেন কম কথা বলি।

২০১৭ সালের শেষে এসে আমার নিজের কতগুলো প্রতিজ্ঞা আছে। এটা আমি গত পাঁচ বছর ধরেই করছি। বেঁচে থাকলে আগামী পাঁচ বছরেও করব। আমার নববর্ষের ইশতেহার আপনাদের সঙ্গে মেলে কি না, দেখুন তো। যদি মিলে যায়, আশা করি আপনারা নিজ নিজ জায়গা থেকে আওয়াজ দেবেন।

১. আগামী বছর ফেসবুক কম করব। ফেসবুক ডট কমে যাব কম কম।

২. আগামী বছর ওজন কমাবই। খাওয়া কমিয়ে দেব এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করব।

৩. জমে থাকা বইগুলো আগামী বছর পড়েই ফেলব।

৪. দুই দিন পরে শোধ দিয়ে দেব বলে যা ধার-কর্জ করেছি, আগামী বছরের মধ্যে তা অবশ্যই শোধ করে দেব।

৫. কাছের মানুষের যত্ন নেব। আত্মীয়স্বজন, পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি যাব।

৬. পরে উপহার দেব বলে দাওয়াত খেয়ে এসেছি, এবার সেই উপহার দেবই দেব।

এ ধরনের আরও কিছু প্রতিজ্ঞা করা যেতে পারে। যেমন, আপনি যদি এমপি বা নেতা হন, আপনি প্রতিজ্ঞা করতে পারেন, ২০১৮ সালে এলাকায় নিয়মিত যাবই যাব। আপনি যদি পদস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে প্রতিজ্ঞা করতে পারেন, যা করার করে ফেলেছি, ২০১৮ সালে আর ঘুষ খাব না। আপনি যদি বড় ব্যবসায়ী-রাজনীতিক হয়ে থাকেন, আপনি ঘোষণা দিতে পারেন, এ বছর ঋণখেলাপির খাতা থেকে নাম কাটাবই কাটাব।

এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করা খুব সোজা। যেমন, একজন ধূমপায়ী বলেছেন, সিগারেট ছাড়া খুব সোজা। গত বছর আমি সাতবার সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।

২০১৭ সালে আমরা অনেক বিশ্ব রেকর্ড করেছি। একটা ছিল, প্রশ্নপত্র ফাঁস। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ক্লাসের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার গৌরব এখন আমাদের। আমরা প্রথম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা এই রেকর্ড ভাঙার ধনুর্ভঙ্গ পণ করতে পারি: আমরা ২০১৮ সালে শিশু শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেব।

গত বছর আমরা অব্যাহত রেখেছি গুম বা নিখোঁজ হওয়ার বিশ্ব রেকর্ড। মানুষ হারিয়ে গেছে, তবে গত বছরের একটা ব্যর্থতা হলো, কোনো কোনো হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরেও এসেছেন। তাঁরা কোথায়, কেন, কীভাবে অন্তর্হিত অবস্থায় ছিলেন, এই বিষয়ে পরবর্তীকালে আর বিশেষ কিছু জানা যায়নি। মনে হয়, ভাওয়ালের রাজার মতো তাঁদের বৈরাগ্য পেয়ে বসেছিল, তাঁরা কিছুদিনের জন্য সংসারত্যাগী হয়ে থাকবেন।

গত বছর ছিল কথামালারও বছর। চমৎকার চমৎকার বচন শুনেছি আমরা। বিবদমান দুই পক্ষ জোরের সঙ্গে একে অপরকে ক্ষমা চাইতে বলেছে, নাকে খত দিতে বলেছে, আবার আগে থেকে একতরফা ঘোষণা দিয়েছে, আমরা ক্ষমা করে দেব, তোমাদের ক্ষমা চাইতে হবে না; আরেক পক্ষ বলেছে, কে কাকে ক্ষমা করে... ইত্যাদি।

বছরের শেষে বাজারে ভাসছে সহনীয় হারে ঘুষ খাওয়ার আহ্বান। এক মন্ত্রী নাকি তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলেছেন, ঘুষ খান, তবে একটু রয়ে-সয়ে খান, সহনীয় পর্যায়ে ঘুষ খান। টিআইবির পক্ষ থেকে নৈতিক কারণে ওই মন্ত্রীর পদত্যাগের নৈতিক দাবি তোলা হয়েছে। আর রম্য সাইটগুলো ঘুষের সহনীয় মাত্রা ধার্য ও ঘোষণা করবার দাবি তুলে কার্টুন প্রকাশ করে ফেলেছে।

আর চলেছে ব্যাংক নিয়ে ব্যাপক ল্যাং মারামারি। একবার বেসিক ব্যাংক তো আরেকবার ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৮ সালের মধ্যে সবার জন্য প্রশ্নফাঁস আর ২০১৯ সালের মধ্যে সবার জন্য একটা করে ব্যাংক এবং একটা করে টেলিভিশন চ্যানেল চাই-ই চাই। বাবা বলছেন, বান্টি, তোর ৬ নম্বর জন্মদিনে তুই কী চাস? ছেলে বলছে, আমি ব্যাংক চাই বাবা। আর মেয়ে বলছে, বাবা, তুমি ভাইয়াকে টিভি চ্যানেল দিয়েছ, আমাকে কেন দেবে না? মেয়ে বলে আমার কি অধিকার নাই? এই রকম বাংলাদেশ নিশ্চয়ই একদিন আসবে। তোমাকে আসতেই হবে...

ওদিকে দুই দুটো বন্যার ধকল গেছে ফারমারদের ওপর দিয়ে। আলুচাষিরা হিমাগারে রেখেছিলেন আলু, দুটো লাভের আশায়। এখন তা বের করতে পারছেন না, বাজারে আলুর দাম নেই, শেষে গরুকে খাওয়ানোর জন্য মাইকিং করে আলু বিক্রি করা হচ্ছে, ও সোনা ভাই, আলু নিয়ে যান ভাই...

আলুর দাম নেই, অন্যদিকে চালের দাম বেশি, বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে গিয়ে গরিব মানুষ হয়ে পড়েছে আরও গরিব। সরকার কেন যে এই স্লোগান ধরছে না, বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপরে চাপ কমান। এ বিষয়ে আমরা অবশ্য সৌদি নাগরিক রোবট সোফিয়ার মত নিতে পারতাম: আচ্ছা, সোফিয়া বলো তো, কেন বাঙালি আলু খেতে চায় না, ভাতই কেন খেতে হবে রোজ?

জাতিসংঘ প্রস্তাব পাস করছে, তবুও রোহিঙ্গা শরণাগতদের স্রোত বন্ধ হচ্ছে না। চীন ও রাশিয়া আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশ অবশ্য সাধ্যাতীত মানবতাবোধের পরিচয় দিয়েছে, অসহায় নারী-পুরুষগুলোকে পুশব্যাক করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দিয়ে তাদের জায়গা করে দিয়েছে।

আর যুক্তরাষ্ট্র কাঁপছে হ্যাশ ট্যাগ মি টু প্রচারণা দিয়ে। সবার জিজ্ঞাসা, হারভির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, হারভি ধরাশায়ী, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি কেন এখনো বহাল-তবিয়ত? আমেরিকানরা অনেক কৌতুক বানিয়েছে, যেমন, আপনি যখন ট্রাম্পের চোখের দিকে তাকান, তখন কী দেখতে পান? উত্তর: তাঁর মাথার পেছনের দিকটা। আপনি যদি ট্রাম্পের মন্ত্রী হতে চান, কী করতে হবে? অস্ত্রোপচার করে মাথার মগজ ফেলে দিতে হবে। কেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ক্যানসারের তুলনা করা যাবে না? কারণ, মাঝেমধ্যে ক্যানসার থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।

পৃথিবী ক্যানসার থেকে মুক্তি পাবে কিংবা পাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলবেন, জলবায়ুর পরিবর্তন একটা অপপ্রচার মাত্র। আর আবহাওয়া তার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েই যাবে। ঝড়ে-জলোচ্ছ্বাসে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে খোদ আমেরিকাই।

বাংলাদেশ তবুও এগিয়ে যাবে। টেস্টে বাংলাদেশ হারাবে অস্ট্রেলিয়াকে, শ্রীলঙ্কাকে, ইংল্যান্ডকে। আমাদের বালিকারা সবাইকে হারিয়ে, একই টুর্নামেন্টে ভারতকে দুবার হারিয়েই হয়েছে সাফ ফুটবলের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। আমরা আশাবাদী হব। আবার দীর্ঘশ্বাসও ফেলব, মেয়ে ফুটবলারদের গ্রাম কলসিন্দুরের ফুটবলার সাবিনা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে দুই দিনের জ্বরে। কৃষকেরা ফল, মাছ, সবজি উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড করেই যাবেন। আমরা মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যেতেই থাকব। রাস্তাঘাট ভাঙা, যানজটে কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা বিনষ্ট। হাজার কোটি টাকা দিয়ে বানানো ফ্লাইওভারের নিচে যানজট, ফ্লাইওভারে কোনো গাড়ি ওঠে না...তা দেখেও কেউ বলবে না, সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ...!

জামিলুর রেজা চৌধুরী কৌতুক শোনাবেন। রাস্তায় গর্ত। একটা গাড়ি গর্তে পড়ে বিগড়ে গেল। পথের ধারে একজন মেকানিক বসে আছেন। গাড়ি সারিয়ে দিলেন। গাড়িওয়ালা খুশি হয়ে তাঁকে বকশিশ দিলেন। মেকানিক পরের গাড়ির জন্য বসে রইলেন।

একজন বললেন, আপনাকে টাকা দিচ্ছি, এই গর্তটা আপনি সারার ব্যবস্থা করবেন কি?

মেকানিক বললেন, গর্তটা তো আমিই বানিয়ে রেখেছি।

চার্লি চাপলিনের সেই ছবিটার কথা মনে আছে? চার্লি চাপলিন তাঁর ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছেন, ছেলে গুলতি মেরে জানালার কাচ ভাঙে, আর চার্লি চাপলিন জানালার কাচ সারিয়ে দেওয়ার কারিগর...তিনি কাচের জানালা মেরামত করেন...

তবুও বলব, ২০১৫ সালের চেয়ে ভালো গেছে ২০১৬, ২০১৬ সালের চেয়ে ভালো ছিল ২০১৭। ২০১৮ সাল আরও ভালো যাক।