নির্বাচনই বড় চ্যালেঞ্জ

ভালো কিছু ভাবনা নিয়ে নতুন বছরটা শুরু করা যাক। কারণ, আজ থেকে শুরু হলো নতুন যে পঞ্জিকা বছর, সেটি হবে উত্তেজনায় ঠাসা। নানা স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষা তো আছেই, থাকবে উৎসব করারও নানা উপলক্ষ। তবে সবকিছুকেই সম্ভবত ছাপিয়ে যাবে জাতীয় নির্বাচন।

একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বড় শর্ত হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণ। ২০১৮ সালের জন্য সবচেয়ে বড় ও ভালো ভাবনা তো এটাই। ২০০৮ সালের পর যাঁরা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁরা তো এমন কোনো ভোটের দেখাই পাননি। পুরোনো ভোটারদের স্মৃতিও হয়তো ক্ষীণ হয়ে গেছে। তবে এখানে যে কথাটি অবশ্যই বলতে হবে তা হলো, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।

আর যদি নতুন বছরটি ভালো ভাবনা দিয়ে শুরু না করি? কারণ, সবকিছু যে ঠিকঠাকই থাকবে, এমনটি না-ও হতে পারে। কেননা, রাজনীতির গতি প্রকৃতি বদলে দেওয়ার নানা উপকরণ বছরজুড়েই থাকবে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জোরেশোরেই বলছে। কিন্তু এখনো তারা বলছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা। তার চেয়েও বড় কথা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের মামলায় দলটির প্রধান খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, সে সংশয়ও রয়েছে। এই মামলার রায়ই সম্ভবত নির্ধারণ করে দেবে বছর শেষের জাতীয় নির্বাচনের নিয়তি। অতিসংশয়বাদীরা এ প্রশ্নও তুলতে পারেন, নির্বাচন হবে তো? আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে এ প্রশ্নটা হয়তো বারবারই আলোচনায় উঠে আসবে।

শুধু নির্বাচনই নয়, স্বপ্নপূরণের আরও কিছু উপলক্ষ থাকবে ২০১৮ জুড়ে। আমরা কি স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে এবারই পার হয়ে চলে যাব দক্ষিণের কোনো একটি জেলায়? ঢাকার বুকে চলবে মেট্রোরেল? কিংবা আমাদের নিজস্ব একটি কৃত্রিম উপগ্রহের উৎক্ষেপণ হবে তো?

উৎসবেরও নানা উপলক্ষ থাকবে বছরটিতে। ফুটবলে বিশ্বের কোনো মানদণ্ডেই হয়তো বাংলাদেশ নেই, কিন্তু সমর্থক হিসেবে তালিকায় ওপরের দিকেইথাকব আমরা। এ বছরের মধ্য জুন থেকে শুরু হবে বিশ্বকাপ ফুটবল। মাসজুড়ে ফুটবলজ্বরে কাতর হব সবাই। ক্রিকেট দেখারও আনন্দ থাকবে নতুন বছরজুড়ে। একটি বছরে আটটি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা তো আমাদের জন্য একেবারেই নতুন।

এসব তো গেল বড় বড় জাতীয় ঘটনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকেও নজর থাকবে অনেকের। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি টিকে থাকবেন? যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়া কি আরেকটি যুদ্ধ বাধাবে? মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি কত দূর পর্যন্ত ছড়াবে—এ রকম নানা বিষয়ে জানার কৌতূহল থাকবে ২০১৮ জুড়ে।

কেউ বিশ্ব নাগরিক হোক কিংবা প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনার—প্রত্যেকের তো একটি ব্যক্তিজীবনও আছে। সেই জীবনে থাকে বিচিত্র চাওয়া-পাওয়া, রংবেরঙের আশা-আকাঙ্ক্ষা। থাকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব। ২০১৮ সালে জীবন কেমন যাবে? গণপরিবহনের নৈরাজ্য, তীব্র যানজট, চালের দামের ঊর্ধ্বগতি, শতক হাঁকানো পেঁয়াজ, রাস্তাঘাটে ঘাপটি মেরে থাকা ছিনতাইকারী, গুম হওয়ার সদা আতঙ্ক—সবই কি আগের মতোই থাকবে? নাকি নির্বাচনের বছরে খানিকটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা থাকবে সরকারের তরফ থেকেও। অশান্তি, দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক—সব বিদায়ী বছরটির মতোই বিদায় নিক। সবকিছু পেছনে ফেলে আরও ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হোক নতুন বছরে।

আধা ডজন মেয়র

ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর অকালপ্রয়াণে নতুন নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে নির্বাচন কমিশনের সামনে। নির্বাচন হওয়ার কথা এই ফেব্রুয়ারিতেই। এ ছাড়া মেয়াদ শেষ হওয়ায় রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে মার্চ-এপ্রিল সময়ে।

এই ছয়টি নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের জন্য আরেক পরীক্ষা। আগের বছরে রংপুর সিটি নির্বাচন প্রশংসিত হয়েছে। প্রশংসার এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখাটাই হবে নতুন বছরে নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার ওপরই নির্ভর করছে ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। অবশ্য সবকিছুর ওপরে থাকবে সরকারের সদিচ্ছা।

ধরে নেওয়া যাক, জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ছয়টি ভালো সিটি নির্বাচন হলো। সেখানে বিরোধী দলের কেউ জিতে গেলে তাঁর পরিণতি কী হবে? তিনি কি মেয়রের চেয়ারে বসতে পারবেন, নাকি মামলায়-মামলায় জর্জরিত হয়ে তাঁকে ঢুকে যেতে হবে জেলে? ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনও শেষ পর্যন্ত হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে সরকারের আদৌ আগ্রহ থাকবে কি না, অনেকের তা নিয়ে সন্দেহ।

চোখ থাকবে আদালতে

প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এইচ এম এরশাদ মামলায় সাজা পেয়ে নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছিলেন। তাতে অবশ্য সেই সময়ে রাজনীতির গতিপথে তেমন কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তবে বেগম খালেদা জিয়া অভিযুক্ত হলে আগামীর রাজনীতিতে তার প্রভাব বেশ বড় হওয়ারই কথা। এ জন্য অবশ্য বেশি দূর যেতে হবে না। রায়ের পরপরই তা দেখা যাবে। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে বহু হিসাব-নিকাশই বদলে ফেলতে হতে পারে।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা দুটি মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া। আর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নিয়ে করা মামলায় আরেক আসামি তাঁরই পুত্র তারেক জিয়া। মামলার রায় হতে পারে ফেব্রুয়ারি বা মার্চে।

নতুন রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন?

প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হবে নতুন বছরে। এমনিতে বর্তমান শাসনকাঠামোতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত। তারপরও নির্বাচনী বছরে সেই ছোট্ট ভূমিকাও হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? বর্তমান প্রেসিডেন্টই কি বঙ্গভবনে থেকে যাবেন, নাকি নতুন মুখ আসবে—তা জানা যাবে আগামী এপ্রিলে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রধান বিচারপতির পদ। সেই ব্যবস্থা অবশ্য এখন আর আইনে নেই। তারপরও প্রধান বিচারপতির পদটি এ সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয়। গত নভেম্বরে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে পদত্যাগ করতে হলে সেই থেকে আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এই জানুয়ারিতেই শেষ হবে তাঁর মেয়াদ, নিয়োগ দিতে হবে নতুন প্রধান বিচারপতিকে। বছরের বাকি সময়ে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম থাকবে না।

সবশেষে জাতীয় নির্বাচন

নতুন বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের একদম শেষ সপ্তাহেই নতুন জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বছরজুড়ে চলবে নানা আয়োজন ও আলোচনা। এরই মধ্যে ভোট চাইতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা অর্জনের কথা তিনি বলছেন। চেষ্টা চলছে আগের দেওয়া বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পূরণের। জুন মাসের বাজেটে হয়তো থাকবে জনতোষণের নানা পরিকল্পনা। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ করার তোড়জোড় চলবে। বাড়বে ব্যয়। খুশি করার চেষ্টা থাকবে প্রশাসনকেও। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব ইতিবাচক হবে না।

ভোটের কথা বলছেন খালেদা জিয়াও। কাদের নিয়ে তিনি নির্বাচন করতে চান, তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাজনীতির মাঠে না থাকলেও জামায়াতে ইসলামীকে নিষ্ক্রিয় বলা যাবে না। মাথাচাড়া দিচ্ছে আরও কিছু ধর্মভিত্তিক দল। তারাই-বা কী করবে? সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো কেমন হবে, তা-ও খুব পরিষ্কার নয়। আমরা এখনো গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো পথ খুঁজে পাইনি। এ রকম অনেক প্রশ্ন আছে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা হবে নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

দুশ্চিন্তা আরও আছে। ভিন্নমতের মানুষেরা কতটা মন খুলে কথা বলতে পারবে? নির্বাচনী হাওয়া কি মতপ্রকাশের দরজা খানিকটা খুলবে, নাকি রুদ্ধ দরজায় আরও তালা পড়বে? শেষ বিচারে আমরা গণতন্ত্রই চাই। চাই মত প্রকাশ করতে। শান্তি চাই, স্বস্তি চাই, সমৃদ্ধিও চাই। এটিই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ২০১৮ সাল সবাইকে সেদিকে নিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে সবশেষে বলা যায়—না থাকে অন্ধকার,/ না থাকে মোহপাপ/ না থাকে শোকপরিতাপ।/ হৃদয় বিমল হোক,/ প্রাণ সবল হোক/

বিঘ্ন দাও অপসারি।

স্বাগত ২০১৮।