বাইরে রাখা যাবে না, নির্বাচন করব: খালেদা জিয়া

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রমনা, ঢাকা, ২ জানুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রমনা, ঢাকা, ২ জানুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এই পার্লামেন্ট রেখে নির্বাচন হবে না। আর হাসিনার অধীনেও নির্বাচন হবে না। আমরা বিএনপি, নির্বাচনী দল। আমরা নির্বাচন করব। বাইরে রাখতে চাইলেই রাখা যাবে না, নির্বাচন করব আমরা।’

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া এ মন্তব্য করেন। ছাত্রদলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভাটির আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।

বেলা দুইটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের মূল ফটক তালাবদ্ধ ছিল। মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়ার পরেও সেটি তালাবদ্ধ থাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। এরপর বেলা তিনটার দিকে দলের নেতা-কর্মীরা মিলনায়তনের মূল ফটকের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় বিএনপির নেতারা বলেন, তালা না খুললে তাঁরা সেখান থেকে যাবেন না।

এরপর বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়া মিলনায়তনের সামনে এসে উপস্থিত হন। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাঁর গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন। মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়ার পরও কেন তা খুলে দেওয়া হয়নি, বিষয়টি জানতে চান খালেদা জিয়া। এরপর তিনি তাঁর গাড়িতে অবস্থান করেন। দলীয় প্রধানের অপেক্ষার সময় দলের নেতারা স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে বিএনপির এক নেতা বিকেল ৫টা ১৬ মিনিটে মাইকে ঘোষণা করেন যে কর্তৃপক্ষ বিএনপি চেয়ারপারসনের সম্মানে মিলনায়তনের তালা খুলে দিয়েছে। এরপর দলের নেতা-কর্মীরা মিলনায়তনে প্রবেশ করে। বিকেল পাঁচটা ৪০ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়া আলোচনা সভার মঞ্চে যোগ দেন।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই তাদের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না। আজকে পার্লামেন্ট বলে কিছুই নেই। হাসিনারা ক্ষমতায় থাকার জন্য পার্লামেন্ট রেখে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এরা কেউ ভোটই পায়নি। এরা পার্লামেন্টের মেম্বার থাকার যোগ্য নয়। কাজেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হবে। আমরা নির্বাচন করব। কিন্তু সে নির্বাচনটি হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। হাসিনার অধীনে নয়। সেই নির্বাচনই এই দেশে হবে। কারণ, সারা পৃথিবী বুঝে গেছে হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, হবে না। সেটা মানুষ বুঝেছে।’

আ.লীগ ক্ষমতায় থাকলে আমরা বাঁচতে পারব না
দেশের পরিবর্তন আনতে হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আমরা আর বাঁচতে পারব না। সে জন্য যে করেই হোক আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। অন্য কোনো সরকার আসতে হবে। জনগণের যারা কল্যাণ চায়, ভালো চায়—তাদের সরকার মানুষ দেখতে চায়। সে জন্যই মানুষ একটি পরিবর্তন চায়। পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। কেন বলছি, প্রথম কথা—হাসিনার অধীনে আমরা যতগুলো নির্বাচন দেখেছি, কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়েছে কেউ বলবে না। বিদেশিরাও বলবে না। হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এবং সুষ্ঠু হবেও না ভবিষ্যতে।’

এক ব্যক্তির ইচ্ছায় সবকিছু চলছে
দেশ এক ব্যক্তির ইচ্ছায় চলছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, আজ এক ব্যক্তির ইচ্ছায় সবকিছু চলছে বলেই কোনো কিছু চলছে না। দেশ আজ অচল। দেশ আজ সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের দিকে যাচ্ছে। মানুষের অবক্ষয় হচ্ছে। এর জন্য দায়ী হলো এই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবার এই দেশে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ মানুষের ওপর নির্যাতন করেছে, গুম-খুন করেছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানুষের জানমালের স্বাধীনতা হরণ করেছে। এই হলো আওয়ামী লীগ। এই দলকে দেশের মানুষ কখনো বিশ্বাস করে না। জনগণের ভোটে তারা কখনো ক্ষমতায় আসেনি। কারও না কারও ঘাড়ে ভর দিয়ে, পা দিয়ে তারা ক্ষমতায় বসেছে। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় বসেনি। সে জন্য তাদের ভয়। এ জন্যই তারা বিএনপিকে ভয় পায়। বিএনপি বারবার জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে গেছে।

এমন অবস্থা, লবণ দিয়ে ভাত খাওয়ারও উপায় নেই
আওয়ামী লীগের ‘পকেটের মধ্যে’ উন্নয়নের জোয়ার বইছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশে উন্নয়নের কোনো জোয়ার নেই। গ্রাম দেশে যান, মানুষের কোনো কাজ নেই। অভাব-অনটন-দুঃখ। জিনিসপত্রের দাম এতই বেশি। প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি।...২০১৪ সালে তো কোনো ইলেকশন হয়নি, কাজেই তখন আর ভোটের জন্য মানুষের কাছে যাওয়ারও দরকার হয়নি, বলারও দরকার হয়নি। এই আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে বলেছিল না, ১০ টাকা সের চাল খাওয়াব? বিনা মূল্যে সার দেব, ঘরে ঘরে চাকরি দেব। কিন্তু তার কোনটি বাস্তবায়ন করেছে তারা? আজকে ১০ টাকা কেজি চালের জায়গায় ৭০ টাকা কেজি চাল। ১২০ টাকা পেঁয়াজ। দেশের মানুষ কী খাবে তাহলে? লবণ দিয়ে ভাত খাওয়ারও উপায় নেই, এমন অবস্থায় চলে গেছে।’

আগে গোলাগুলি করে ব্যাংক ডাকাতি হতো, এখন বোঝা যায় না
সরকার এই আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এখন পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু পদ্মা সেতু এই আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। আর সেই সেতুতে ওঠার জন্য...একটি যদি জোড়াতালি দিয়ে বানায়, সেই সেতুতে কে উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক (ঝুঁকি) আছে।’ ব্যাংক খাতে ডাকাতি হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এর আগে শুনেছিলাম ব্যাংক ডাকাতি হতো গুলি করে। আর এখন ব্যাংক ডাকাতি এমন সুপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে, কেউ টের পাচ্ছে না। পরে খবরের কাগজে আমরা দেখছি, জানছি কী সুন্দরভাবে ঠান্ডা মাথায় ব্যাংকগুলোর সব টাকা লুট করেছে। এগুলো কার টাকা? জনগণের টাকা। আওয়ামী লীগ এলেই কেন শেয়ারবাজারে ধস নামে? শেয়ার মার্কেটের টাকা কোথায় যায়?’

প্রধান বিচারপতির নিয়োগ বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কারণ এখনো মতলবটা তাদের ভালো নয়, সে জন্যই। কিন্তু মওদুদ সাহেব বলেছেন যে একদিনও নাকি খালি রাখা যায় না প্রধান বিচারপতির পদ। কাজেই আমরা বলতে চাই, হাসিনা যা চাইবে, সেটা না করলেই তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। তার নামে মামলা হবে। তাকে জেলে যেতে হবে, অত্যাচারিত হতে হবে। যদি এক ব্যক্তি সবকিছু করে, তাহলে এক ব্যক্তির শাসন তো এ দেশে চলতে পারে না। এ জন্য তো এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেনি। এ দেশের মানুষ করেছিল যখন পাকিস্তানিরা এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা দিচ্ছিল না। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যই তো এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু সে অধিকার তারা (সরকার) কেড়ে নিয়েছে।’

জঙ্গি আ.লীগের সৃষ্টি
সরকার কথায় কথায় জঙ্গির ভয় দেখায় অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এই আওয়ামী লীগ জঙ্গি সৃষ্টি করেছিল। জঙ্গিদের বড় বড় নেতা, শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাই—সব তাদের আত্মীয়স্বজন। জঙ্গি তো তারা সৃষ্টি করেছে। কথায় কথায় কিছু হলেই জঙ্গির ভয় দেখায়। কিন্তু এই জঙ্গি আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গি নয়। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। তারা শান্তিতে থাকতে চায়, তারা জঙ্গি হতে চায় না। কিন্তু তাদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জঙ্গি বানানো হচ্ছে। বিদেশিদের কাছে জঙ্গি দেখানো হচ্ছে। দাড়ি-টুপিওয়ালা হলেই সে জঙ্গি হয়ে যায়।’

আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি দাবি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের ডাকে দেশের ছাত্র, যুবক, সাধারণ মানুষ সবাই সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের সাহায্য করেছে, আমাদের লোকজনকে থাকার অনুমতি দিয়েছে, তাদের সে জন্য ধন্যবাদ। আমরা বন্ধু হিসেবে সব সময় মনে রাখব। কাজেই তাদের (ভারত) বন্ধুর মতো দেখতে চাই। আমরা ভালো সম্পর্ক চাই। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি। এটা দিয়েছে শহীদ জিয়াউর রহমান। যেটা দেওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের, তাদের নেতাদের দিয়ে সেধেও পারা যায়নি।’

পুলিশের দোষ নেই, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে
পুলিশের কর্মকাণ্ড বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা তো শৃঙ্খলা মেনেই চলতে চাই। কিন্তু শৃঙ্খলা ভাঙেই তারা, আওয়ামী লীগ ভাঙে; তার লোকজনকে দিয়ে করায় এবং পুলিশকে প্রতিটি কাজে ব্যবহার করে। পুলিশ খারাপ নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ খারাপ করছে তাদের। পুলিশকে আমরা বলব, আপনারা জনগণের সেবক। এই দেশের মানুষ আপনাদের কাছে সবাই সমান। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল—সবার কথা আপনাদের চিন্তা করে সেভাবে আপনারা এগোবেন। আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই কিংবা আপনাদের ওপর আমাদের কোনো রাগও নেই। আপনারা আপনাদের মতো কাজ করে যাবেন, কিন্তু আমি বলি—এই যে কথায় কথায় আমার ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়! আজও অনেক ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এই যে কথায় কথায় আমাদের ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া, সেগুলো বন্ধ করেন। ঘরে ঘরে গিয়ে ছেলেদের ধরা, এগুলো বন্ধ করেন। আর যাদের জেলখানায় রেখেছেন, এখন তাদের ছেড়ে দিন।’

ছাত্রদল কীভাবে কর্মসূচি পালন করে তা দেখতে গোয়েন্দা নিয়োগ
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ছাত্রদের যেসব সমস্যা, সেসব বিষয়ে নিয়ে কাজ করতে হবে। কথা বলতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও কথা বলতে হবে। বিদেশ থেকে ভালো ভালো ডিগ্রি নিয়ে এসেও অনেকে এখন চাকরি পায় না। বিএনপি শিক্ষিত বেকারদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করবে।

শুধু চেহারা দেখালে আর ছবি ওঠালে হবে না উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘১০-১২ জন লোক নিয়ে ছবি ওঠাল, আমি রাস্তায় ছিলাম-আমি আন্দোলনে ছিলাম—এগুলো আর চলবে না। আমরাও বিকল্প ব্যবস্থা করেছি। তোমরা কীভাবে চলছ, কর্মসূচিগুলো কীভাবে পালন করছ, সেগুলো দেখার জন্য আমরা গোয়েন্দা নিয়োগ করেছি। বিএনপি নেতৃবৃন্দও তার মধ্যে (নজরদারি) থাকবে। কেউ বাদ যাবে না।’

ছাত্রদলের সভাপতি রাজীব আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন নবী খান সোহেল, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন প্রমুখ।