দখলমুক্ত না করেই সংস্কার!

মঙ্গলীছড়ার ওপর নির্মিত সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ি। সম্প্রতি সিলেট নগরের সরষপুরে l আনিস মাহমুদ
মঙ্গলীছড়ার ওপর নির্মিত সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ি। সম্প্রতি সিলেট নগরের সরষপুরে l আনিস মাহমুদ

সিলেট নগরের কেন্দ্রস্থলের রিকাবিবাজার-লামাবাজার এলাকা দিয়ে প্রবাহিত মঙ্গলী ছড়া। প্রাকৃতিক এ নালা মিশেছে সরাসরি সুরমা নদীতে। সাড়ে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ছড়ার মধ্যভাগ সরু হতে হতে করুণ এক রূপ ধারণ করেছে। ৪০ ফুট প্রস্থ্যের ছড়ার অর্ধেক অংশজুড়ে দখল করে আছে জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি। এই গ্যালারির চেয়ে বেশি দখল করে আছে বসতবাড়ি।

এসব দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ না নিয়েই মঙ্গলীসহ নগরের ১২টি ছড়া ও খাল সংস্কারের জন্য সিটি করপোরেশন ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রাকৃতিক জলপ্রবাহকে সচল করে জলাবদ্ধতামুক্ত নগর গড়তে সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এটি সিলেট নগরে সবচেয়ে বড় অঙ্কের বরাদ্দ। এরই মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু দখল জিইয়ে রেখে ছড়া-খাল সংস্কার কতটুকু সুফলতা বয়ে আনবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শহরের দক্ষিণ দিকে সুরমা নদী, উত্তর-পূর্বে চা-বাগান ও টিলা। টিলা থেকে প্রাকৃতিকভাবে আসা ৯টি ছড়া এবং ৩টি খাল নগরের বিভিন্ন মহল্লা ঘুরে সুরমায় গিয়ে মিশেছে। এগুলোই শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে জলপ্রবাহের প্রাকৃতিক ধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল দপ্তরের জরিপ বলছে, ১২টি ছড়া-খাল দখল-দূষণে বিপন্ন অবস্থায় আছে। সরকারি স্থাপনা থেকে শুরু করে বসতবাড়ির অংশবিশেষ, বহুতল ভবনসহ অন্তত ১ হাজার অবৈধ স্থাপনা রয়েছে এসব ছড়া-খালে।

ছড়া-খালগুলো দখলমুক্ত না করে এত বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব, জানতে চাইলে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় তিনি কারাবন্দী ছিলেন। তাই প্রকল্প গ্রহণ, অর্থ বরাদ্দ অনেকটা মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক পর্যবেক্ষণ থেকে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার দেখামতে ছড়া-খাল বিপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ দখল ও দূষণ। কিন্তু এ দুটো বিষয় বাদ দিয়ে ছড়া-খালের সংস্কার সম্ভব না। আবার প্রকল্প চলমান থাকায় এ নিয়ে আলোচনায় কোনো সুফল আসবে বলে মনে হয় না। তাই এ প্রকল্পের দায় আমি নেব না।’

এর আগে ২০০১ সালে ২৫ লাখ ও ২০০৯ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২টি প্রকল্পের আওতায় ৪টি ছড়া খনন এবং ছড়ার তীর সংরক্ষণে সাড়ে ৫ কিলোমিটারব্যাপী আরসিসি রিটেইনিং দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল।

এ বছর সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১২টি ছড়া-খাল খনন ও তীর সংরক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য ২৩৬ কোটি টাকার বৃহৎ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। বরাদ্দের ২০০ কোটি টাকা সরকার দেবে, বাকি ৩৬ কোটি টাকা সিটি করপোরেশনের। এ জন্য গত মাসে ‘সিলেট মহানগরের মধ্যে প্রবহমান ছড়া-খাল সংরক্ষণ ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ২টি দরপত্রও আহ্বান করেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এগুলো হচ্ছে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ছড়া-খাল খনন এবং ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ছড়া-খালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ। তবে এ প্রকল্পে ছড়া থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগামী বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

খালগুলোর প্রশস্ততা কমছে

দখলের কারণে সিলেট নগরের ছড়া-খালগুলোর প্রশস্ততা দিন দিন কমছে। রিকাবীবাজার-লামাবাজার এলাকায় জেলা স্টেডিয়ামের ঠিক পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত মঙ্গলী ছড়া দরগাগেট পেছনের অংশ হয়ে সরষপুর, দাড়িয়াপাড়া, তালতলা, কাজিরবাজার এলাকা হয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। অন্যদিকে একই ছড়াটির আরেকটি অংশ দরগাগেট পেছনের অংশ দিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার পাশ ঘেঁষে চৌহাট্টা, লোহারপাড় হয়ে সাপ্লাই রোডের দিকে চলে গেছে। মঙ্গলী ছড়ার মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ৭ কিমি এবং প্রশস্ততা গড়ে ২৫ থেকে ৪০ ফুট বলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ছড়ার সরষপুর, চৌহাট্টা, দাড়িয়াপাড়া অংশের প্রশস্ততা এখন বড়জোর ৮ থেকে ১২ ফুট।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলী ছড়ার সরষপুর এলাকার অংশে স্টেডিয়ামের অন্তত ১৪টি বড় পিলার পড়েছে একেবারে ছড়ার মধ্যে। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলেই পানির স্রোতে পিলারের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা আটকে পানিপ্রবাহের পথ প্রায়ই রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া আশপাশের অন্তত ১৭টি বাসার মালিকেরা ছড়ার পাড় দখল করে দেয়াল নির্মাণের পাশাপাশি বসতি তৈরি করেছেন। এ কারণে ছড়ার প্রশস্ততা অনেকটাই কমে গেছে।

১৯৯৩ সালে নির্মিত জেলা স্টেডিয়ামটি দেখভাল করে সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থা। জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে এর সভাপতি। স্টেডিয়ামের গ্যালারির পিলার ছড়ার ভেতরে কেন, জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগেই এটা নির্মাণ করা হয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে হয়েছে, তা জানা নেই। তবে এ কথা সত্য, স্টেডিয়ামের স্থাপনা দেখে দখল আরও পাকাপোক্ত পেয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সরষপুর এলাকার একই অংশে অন্তত ১৭টি বাসা ছড়ার পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে। এর একটি ছায়ানীড় ১৬/২। ওই বাসার আঙিনায় গিয়ে দেখা গেছে, আশপাশের সব বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ছড়ার মধ্যে ফেলা হয়। নগরের কেন্দ্রস্থলের দরগাগেইট এলাকায় মঙ্গলী ছড়ার একাংশ দখল করে ‘রিজ টাওয়ার’ নামের বহুতল ভবনের পার্কিং করা হয়।

মঙ্গলী ছড়ার দখলকৃত এ অংশ ছাড়াও সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫৯টি বহুতল ভবন, বিপণিবিতান, বাসা, কমিউনিটি সেন্টার ও ক্লিনিক অবৈধভাবে ১২টি ছড়া-খালে গড়ে উঠেছে বলে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। সিটি করপোরেশনের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী জানান, দখলকারী স্থাপনার আনুমানিক পরিসংখ্যান তাঁদের কাছে থাকলেও কারা এর দখলে রয়েছে, সে বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। ফলে ছড়া-খালের কতটা দখল বা ভরাট হয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা নেই।

নগরের উত্তর অংশে প্রবাহিত হলদি ছড়াটির মোট দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এটি নগরের সোবহানীঘাট, চালিবন্দর, ছড়ারপাড় এলাকা দিয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়াটি চালিবন্দর এলাকায় দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটি অংশ ছড়ার পাড় দিয়ে সুরমা নদীতে মিশেছে, অন্য অংশটি একটি খালে রূপ নিয়ে কামালগড় এলাকায় চলে গেছে। কামালগড় এলাকা দিয়ে চলে যাওয়া অংশটি তিন বছর আগেও ১২ থেকে ১৫ ফুট প্রশস্ততা থাকলেও এখন সেটি মাত্র ২ থেকে ৪ ফুটে দাঁড়িয়েছে। এ খালের পাড়েই অবস্থিত বস্তি ও বাসাবাড়ির মালিকেরা খালটির অধিকাংশ অংশ দখল করে নিয়েছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন। একইভাবে ছড়ারপাড় দিয়ে প্রবাহিত হলদি ছড়াটির পাড় দখল করেও অন্তত অর্ধশতাধিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনা নির্মাণকারীদের ছয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেছেন, ২৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ছড়া-খাল খনন, রিটেইনিং ওয়াল, ইউটাইপ ড্রেন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের কাজ চলাকালে যেসব অবৈধ স্থাপনা পাওয়া যাবে, সেগুলো অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী নগরের জল্লারপাড়, স্টেডিয়াম মার্কেট, দরগাগেইটের সামনে বহুতল ভবনের সামনে দিয়ে প্রবাহিত ছড়ার উদাহরণ টেনে বলেন, দখলমুক্ত না করে এসব ছড়ার ওপরের অংশ পাকা করে রাস্তা করা হচ্ছে। এতে করে ছড়া আর ছড়া থাকছে না, বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা সময়ে এসে পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ছড়া-খালের সংস্কারকাজ শুরু হলে বরং দখল জিইয়ে রাখার নামান্তর হবে।